‘জুলাই’—এটা কেবল একটি মাসের নাম নয়, বরং একের পর এক অকালপ্রয়াণের প্রতীক। বাংলাদেশের জাতীয় চেতনাজুড়ে এই মাসটি যেন রক্তাক্ত স্মৃতির এক দীর্ঘ ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে গুলির শব্দে থেমে গিয়েছিল তরতাজা শিক্ষার্থীদের জীবন। সেবারের দাগ শুকাতে না শুকাতেই, ২০২৫-এর জুলাই নিয়ে এল আরেকটি বিভীষিকাময় সকাল—এইবার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল শিশুদের স্বপ্ন, আর সঙ্গে পুড়ল গোটা জাতির বিবেক।
ঢাকার উত্তরায় একটি বিদ্যালয়ের ওপর ভেঙে পড়ল বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান। মুহূর্তেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল স্কুল ভবন, গলে যেতে লাগল বেঞ্চ, বই আর কোমল প্রাণের শরীর। পোড়া চামড়ার গন্ধে মিশে গেল溶 ঘামে ভেজা স্কুলড্রেসের পরিচিত ঘ্রাণ। যারা সকালে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে পড়তে গিয়েছিল, সন্ধ্যায় তাদের ফিরিয়ে আনতে হল লাশ হয়ে—কেউ-বা ফিরলই না। জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের নির্জন বিছানায় নিথর হয়ে আছে তাদের নিঃশব্দ প্রস্থান।
ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকে ঘুরে বেড়ানো ভিডিওগুলোতে দেখা গেল আগুনের ভেতর দিয়ে ছুটে চলা শিশুদের চিৎকার—“মা… মা…” সেই আর্তনাদ যেন ছাপিয়ে গেল দেশের প্রতিটি দেয়াল। হাসপাতালের বারান্দায় অসহায় বাবা-মায়ের কান্না দেখে মনে হয়—এই রাষ্ট্রে মাতৃত্বও আজ অসহায়।
কিন্তু তবুও রাষ্ট্র নির্বিকার। বারবার একই নাটক—একটি ‘তদন্ত কমিটি’, কিছু লোকদেখানো শোকবার্তা, আর কিছুদিনের মধ্যেই বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া প্রতিশ্রুতি। আমরা যেন এক বিষণ্ন চক্রে আটকে গেছি—শোক, কমিটি, বিস্মৃতি। অথচ প্রতিটি শিশুই ছিল একেকটি সম্ভাবনার গল্প। এখন সেই গল্পগুলো অসমাপ্ত, অথচ রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা শেষ হয়ে গেছে একটি কালো ব্যাজ আর একটি ফেসবুক পোস্টে।
প্রশ্ন একটাই: বিমানটি জনবহুল এলাকায় কেন?
আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, প্রশিক্ষণ বিমান কেবল জনবিরল এলাকায় পরিচালিত হওয়া উচিত। অথচ বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান কেন চলছিল রাজধানীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়? এটি কী নিছক অবহেলা, নাকি বড় কোনো নীতিগত ব্যর্থতা?
তদন্ত কমিটি নামক প্রহসন আর কত?
প্রতিবারই একটি দুর্ঘটনার পর দেখা যায়, তড়িঘড়ি করে গঠিত হয় একটি তদন্ত কমিটি। কিন্তু কয়টি রিপোর্ট আমরা দেখি? কয়টি সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়? প্রশ্ন থেকে যায়—তদন্ত কি দায়মুক্তির হাতিয়ার, নাকি সত্যিকারের জবাবদিহির পথ?
চিকিৎসায় আমরা কতটা প্রস্তুত?
জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে অনেক শিশু। চিকিৎসকরা বলছেন, জরুরি ভিত্তিতে দুষ্প্রাপ্য নেগেটিভ গ্রুপের রক্তের প্রয়োজন। স্বেচ্ছাসেবীরা নিরলসভাবে চেষ্টা করলেও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সমন্বয়ের অভাব চোখে পড়ার মতো। এই মুহূর্তে প্রয়োজন হলে আক্রান্তদের বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থাও করা উচিত—শিশুর জীবনের মূল্য কোনো প্রটোকল দিয়ে মাপা যায় না।
জনতার ভিড়, উদ্ধার কাজে বাধা
উদ্ধারকারী দল শুরুতেই কাজ শুরু করলেও জনতার ভিড়ে কার্যক্রম ব্যাহত হয়। অনেকেই ভিডিও তুলতে ব্যস্ত, কেউ কেউ সেলফি তোলার প্রতিযোগিতায়। মর্মান্তিক মুহূর্তেও যদি এমন নিষ্ঠুর আত্মকেন্দ্রিকতা দেখা যায়, তবে মানবিকতা নামক মূল্যবোধটির কবর রচনা করছে আমরাই।
বিমানবন্দর শহরের মধ্যে—এখনও বাস্তবতা?
ঢাকার ভেতরে বিমানবন্দর রাখা কতটা যুক্তিযুক্ত? বহু আগেই পরিকল্পনা হয়েছিল মাদারীপুর-শরীয়তপুর সীমান্তে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের। কিন্তু বাস্তবায়নের কোনো অগ্রগতি নেই। রাজধানীর আকাশে বিমান চলাচল মানেই প্রতিনিয়ত লাখো মানুষের জীবনের ঝুঁকি।
এখন করণীয় কী?
অবিলম্বে ঢাকার আকাশে প্রশিক্ষণ বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে
বেসামরিক বিমান ও প্রশিক্ষণ ফ্লাইট স্থানান্তর করতে হবে জনবিরল এলাকায়
এই দুর্ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে হবে
আহত শিশুদের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে—দেশে না হলে বিদেশে
জাতীয় দুর্যোগ থেকে কাঠামোগত শিক্ষা গ্রহণ করে ব্যবস্থা সংস্কার করতে হবে
উপসংহার
আমরা আর কোনো শিশুর অকালমৃত্যু দেখতে চাই না। চাই একটি জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র, একটি মানবিক প্রশাসন এবং একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ। যারা সন্তান হারিয়েছেন, তাদের শোক ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কিন্তু যদি এই শোক আমাদের সিস্টেম বদলাতে না বাধ্য করে, তবে আমরা প্রস্তুত হচ্ছি আগামী দিনের আরও ভয়াবহ মৃত্যুর জন্য।