হঠাৎ করেই মাংসের বাজারে কমে গেছে গরুর গোশতের দাম। কেজি প্রতি দেড় থেকে দুইশো টাকা। কোথাও কোথাও ৩০০ টাকা কমে মিলছে। এতে স্বস্তি ফিরিছে ভোক্তাকুলে। দোকানিদের বিক্রিও বেড়েছে কয়েকগুণ।
রাজধানীর বেশ কয়েকটি মাংসের বাজারে ক্রেতাদের ভিড় বাড়ায় বিক্রেতারাও খুশি। দুই পক্ষই বলছে, অনেক দিন পর এ বাজারে ‘স্বস্তি’ ফিরেছে।
হাজারিবাগ,লালবাগ, কামরাঙ্গীরচরসহ বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে ক্রেতা-বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলেছে দৈনিক দেশ বুলেটিন । মাংস বিক্রেতারা বলছেন, দামের কারণে বিক্রি একেবারেই কমে গিয়েছিল। খুব প্রয়োজন না হলে কেউ গরুর মাংস কিনতেন না। দাম কমায় লাভের অংক কমেছে। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে প্রচুর।
ক্রেতারা বলছেন, অনেক দিন পর মাংসের দাম রাতারাতি কমে যাওয়ায় স্বস্তি হচ্ছে। আগে নিয়ম করে মাসে একবার-দুবার মাংস খাওয়া হতো। এবার মনে হচ্ছে, মাসে কয়েকবার খাওয়া যাবে। দাম বেড়ে গেলে তারা নাকি আর মাংস কিনবেন না।
ক্রেতা-বিক্রেতারা খুশি হলেও অখুশি খামারিরা। তারা বলছেন, হুট করে দাম কমতে থাকলে তাদের উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। বিশেষ করে দেশি জাতের গরু উৎপাদনের তাদের ভোগান্তির আশঙ্কা বেশি।
গরুর মাংসের দাম কমার প্রভাব পড়েছে মাছ-মুরগির বাজারেও। হাজারিবাগের বাজারে সব ধরনের মাছ ও ব্রয়লার মুরগির কেজি ১০ থেকে ২০ টাকা করে কমেছে। মাছ বিক্রেতারা বলছেন, তাদের কাছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজির নিচে কোনো দেশি মাছ নেই। দাম কমায় ভোক্তারা মাছের বদলে পরিবারের জন্য মাংস কিনছেন। তাই ১০ থেকে ২০ টাকা করে মাছের দাম কমিয়েছেন।
এই দাম করার ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন ক্রেতারা। তারা বলছেন, দামের কারণে যারা এ প্রাণিজ আমিষ প্রায় গ্রহণ করেত পারত না, তাদের উপকার হলো অনেক বেশি।
রাজধানীর লালবাগের একটি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মোঃফারুক মিয়া । গত শনিবার (২৩ ডিসেম্বর) তিনি বাজারে এসেছেন মাংস কিনতে। কথা হলে তিনি বলেন, কোরবানির ঈদ ছাড়া আমাদের মাংস খাওয়া হয় না ।দাম বাড়ার কারনে মাংস খাওয়া হয় না বেশ কিছু দিন। গত কয়েকদিন ধরে দাম কমায় বাজারে আসতে সাহস করলাম। গত সপ্তাহে এক কেজি মাংস কিনেছিলাম। আজও এক কেজি কিনেছি।
তিনি আরও বলেন, পরিবারের সবাই গরুর মাংস পছন্দ করে। কিন্তু ৯০০ টাকা কেজি দরে কেনাটা আমার জন্য কষ্টকর। খাওয়াও প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গরুর চাহিদা মুরগির মাংস দিয়ে পূরণ হচ্ছিল। দাম কমায় এখন বেশি করে কিনে রাখছি।
গরুর মাংসের দাম কমায় নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরেছে বলে জানান আশিক নামে এক মুদি দোকানদার। নবাবগঞ্জ বাজারে গরুর মাংস কিনছিলেন তিনি। আশিক জানান, শাক-সবজির পাশাপাশি সপ্তাহে দুয়েকদিন মাছ খাওয়া হতো তাদের। সপ্তাহে একদিন মুরগির মাংস রান্না হতো তার। খেতে খেতে অভক্তিও লেগে গিয়েছিল। দাম কমায় সপ্তাহে তাদের খাবারের তালিকায় একদিন গরুর মাংস থাকছে।
দাম কমায় লাভ কেমন হচ্ছে, এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয় নবাবগঞ্জএর মাংস ব্যবসায়ীদের কাছে। তারা জানান, আগের চেয়ে বিক্রি দ্বিগুণ বেড়েছে। কিন্তু লাভের পরিমাণ আগের মতোই আছে। দাম কমায় বিক্রি বেশি, তাই বলে যে লাভও বেশি হচ্ছে বিষয়টি তা নয়।
গত মার্চে গরুর মাংসের দাম বেড়ে প্রতি কেজি ৯০০ টাকা হয়েছিল। ফলে সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায় এ প্রাণিজ আমিষ। বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, চাহিদা কমে যাওয়ায় দাম কমেছে। প্রান্তিক খামারিরা বিষয়টি ‘হুমকি’ হিসেবে দেখছেন।
কেরানিগঞ্জের খামারি খোকন মিয়া দৈনিক দেশ বুলেটিনকে এ ব্যাপারে বলেন, গো-খাদ্যের দাম গতবছরের চেয়ে এখন বেশি। গরুর প্রধান খাবার ঘাস-লতা-পাতা, খড়-দানাদার খাদ্যের দামও প্রচুর। লাভ কোনোরকম হচ্ছেই না। অথচ বাজারের মাংসের দাম কমে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে খামারিরা আগ্রহ হারাবে। এতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে এ খাত।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম বলেন, সরকারের উচিত হবে একটি বাড়ি, একটি খামার প্রকল্পকে গুরুত্ব দেওয়া। এখানে প্রতিটি বাড়িতে দুটি করে গরু প্রণোদনা হিসেবে দিতে হবে। এতে করে দেশে ব্যাপক উৎপাদন বাড়বে। তখন ৬০০ না ৪০০ টাকা করেও মাংস বিক্রি করা যাবে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এই খাতকে গুরুত্ব দিলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের ১৪১টি দেশে মাংস রপ্তানি করা সম্ভব বলেও তিনি মনে করেন।
তিনি আরও বলেন, এটিকে নিয়ম করে সঠিকভাবে পালন করলে গরুর দাম কমে গেলেও কোনো প্রান্তিক খামারির ক্ষতি হবে না। কিন্তু মূল সমস্যা সিন্ডিকেটের। যারা এতে যুক্ত, তারা দাম বাড়িয়ে দেন। এতে করে খামারি-ব্যবসায়ি-ভোক্তা ৩(তিন )পক্ষের ক্ষতি হয়। যারা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে বেশি লাভ করছেন তাদের কারণে বিশেষ করে ডেইরি মালিকদের লাভের পরিমাণ কমে যাবে।
সর্বশেষ ২০১৮ সালে মাংস ব্যবসায়ী সমিতি ও সিটি কর্পোরেশন মিলে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ করে ৩২০ টাকা। ২০১৯ সালে সমিতির বিভিন্ন সংস্কারের পরামর্শ না শুনে সরকার দাম নির্ধারণ বন্ধ করে দেয়। ফলে মাংসের দাম বেড়ে কেজি প্রতি ৫০০ টাকা হয়ে যায়। ২০২০ সালে মাংসের দাম গিয়ে ঠেকে ৬০০ টাকায়। ২০২১-২২ সালে ৭০০, চলতি বছর মাংসের দাম বেড়ে হয় ৯০০ টাকা।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে মাংসের উৎপাদন ছিল ৮৭ লাখ টন। দেশের বাজারে মাংসের চাহিদা ছিল ৭৬ লাখ টন। ফলে চাহিদার তুলনায় ১১ লাখ টন বেশি মাংস উৎপাদিত হয়েছে। কিন্তু সিন্ডিকেটের কারণে মাংসের দাম বেড়ে যায়। ফলে এ আমিষ থেকে কার্যত মুখ ফিরিয়ে নেয় ভোক্তারা। সংকট বাড়ে বিক্রেতাদের।
চলতি বছর উৎপাদন বাড়ায় মাংসের দাম কমেছে; ফলে স্বস্তি ফিরেছে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে। এ ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে দেশের মানুষ নিয়ম করে মাংস কিনবে, ব্যবসায়ীরাও তাদের খরা কাটাতে পারবেন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।