1. admin@desh-bulletin.com : নিজস্ব প্রতিবেদক : দৈনিক প্রতিদিনের অপরাধ
বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫৩ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
রূপগঞ্জে রাস্তায় অবৈধ যানবাহনে বাড়ছে দুর্ঘটনা শিক্ষার্থীদের সচেতনতার লক্ষ্যে মাদকবিরোধী সভা অনুষ্ঠিত হয় চিরিরবন্দরে ইসকনের হামলায় আইনজীবী হত্যা ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ পবিপ্রবিতে আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত ০২৫-২০২৬ সেশনের জন্য নির্বাচিত উপজেলা আমীরগণের শপথ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। গাজীপুর সদর উপজেলা জাসাস এর কার্যনির্বাহী কমিটির মতবিনিময় ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় গলাচিপায় ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির স্বেচ্ছাসেবকদের মাঝে দুর্যোগকালীন সময় ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ প্রধান শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করার নির্দেশ রিশালে এসে সাবেক স্বামীর কবর জিয়ারত করলেন পরিমণি বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ অপি দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে বাড়িতে এসেছে আজ

গল্পের নাম সিঁদুর লেখকের নাম মো. সেলিম হাসান দুর্জয়

শফিকুল ইসলাম শফিক
  • প্রকাশের সময় : বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪
  • ১০ বার পড়া হয়েছে
বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন। আমার গাড়ি এসে থামলো মূল ফটকে। বেশ জনসমাগম। পুলিশ আর আনসার সদস্যগণ হুইসেল বাজিয়ে দ্রুত আমার চলার পথ করে দিলেন। ভিআইপি কেবিনে প্রবেশ করলাম। ট্রেন রাত সাড়ে এগারটায়। আগামীকাল চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলার উদ্বোধনে আমাকে প্রধান অতিথি করা হয়েছে। সেই উদ্দেশ্যে আজকের যাত্রা। ট্রেন জার্নি আমার ভালোই লাগে। খুব উপভোগ করি। কয়েকজন জুনিয়র অফিসার সাথে ছিল। কেবিন রুমের ভিড় কমানোর জন্য তাদের বিদায় জানালাম। পুলিশ সদস্যসহ অন্যান্যরা রুমের বাইরে। হঠাৎ চোখে পড়লো একজন ভদ্র মহিলা বসে আছেন। উনার দিকে তাকিয়ে মনে হলো উনি বিব্রতবোধ করছেন সম্ভবত। পরিবেশ স্বাভাবিক করতে উনাকে হ্যালো জানালাম। ভদ্রমহিলা মৃদু হেসে মাথা নাড়ালেন। আশ্বস্ত হলাম। আমার ট্রেন আসার এখনো বিশ মিনিট বাকি। টেনশন হচ্ছে। দেশ, দেশের মানুষ, রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন কি এক অবস্থা! মোবাইল স্ক্রিনে অনিচ্ছুক স্ক্রল করছি। কেউ একজন আমাকে ডাকলো- নিমাই নামে! আমি মুখ ফিরাই উপরে। রাজ্যের সমগ্র বিস্ময় আমার চোখে-মুখে! এ নামে কে ডাকবে আমায়? এত বছর পর! প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর! সেই নিঝুম গ্রাম। মেঠোপথ। বাঁশঝাড়ের পাশে কদমগাছ। বৃষ্টির পানিতে আধো স্নানে কুমারী কদমফুল। আমাদের ছিমছাম মা-ছেলের ছোট্ট চৌচালা টিনের ঘর। উঠোনের সামনে মায়ের স্নেহের মহিমায় গড়ে উঠা সবজির বাগান। আর একজন ছিল। ঊষসী। ঊষসী মিত্র। আমার খেলার সঙ্গী। কথা বলার সঙ্গী। বিপদে ভরসার সঙ্গী। ঊষসী ছাড়া কারো সাথে কথা বলতে আমার ভালো লাগতো না। সবাই নিজেকে বড় করতে চায়, বড় প্রমাণ করার জন্য ঝগড়া করে। ঊষসী এমন নয়। ‘ও’ আমাকে বড় করে সবসময়। আমাকে গুরুত্ব দেয়। আমি খুব দুর্বল ছিলাম। অন্যরা যখন আমাকে মারতো, বকা দিত ঊষসী সবাইকে বকে দিতো। আমার পক্ষ নিতো সবসময়। যখন ভয়ে কাঁদতাম, ঊষসী কখনো কখনো রাগ দেখাতো- তুই ওদের মারতে পারিস না? তোর মুখ নেই। আমি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আর ফ্যালফ্যাল করে কাঁদতাম। ঊষসী রাগ করে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকতো। তারপর আমার চোখ মুছে দিয়ে বলতো- ধুর বোকা, তুই তো লক্ষ্মী ছেলে, আমার নিমাই। তুই কেন ওদের মতো হবি! তুই হবি অনেক বড়। আমার বাবার মতো প্রফেসর। চশমার নীচ দিয়ে তাকিয়ে বলবি- এই ছেলেমেয়েরা পড়া শিখেছিস? এই বলে ঊষসী শব্দ করে হেসে দিতো। ওকে খুব মিষ্টি লাগতো তখন। আমিও তখন হাসতাম। আমি আর ঊষসী একই স্কুলে পড়তাম। একই ক্লাসে। পড়াশোনায় দুজনই খুব ভালো ছিলাম। ‘ও’ বরাবরই ক্লাসে প্রথম হতো আর আমি দ্বিতীয়। নম্বরের পার্থক্য খুবই কম। এই দুই কিংবা তিন নম্বরের ব্যবধান। রেজাল্টের দিন ঊষসী মুখ ফুলিয়ে রাখতো। সারা রাস্তা কথা বলতে চাইতো না। আমি খুব খুশি হতাম। ‘ও’ বলতো তুই প্রথম আমি দ্বিতীয়। আমি হেসে হেসে বলতাম- ইয়েস ম্যাম। ঊষসী রেগে যেতো। এভাবেই দিন চলতে লাগলো। মা,আমি আর ঊষসী। বাবার অকাল মৃত্যুতে মা ছিল আমার সবকিছু। বাবা যখন ছিল আমার মনে আছে- আমি কোনোকিছুতেই তখন ভয় পেতাম না। বাবার হাত ধরে হাঁটলে নিজেকে রাজা রাজা মনে হতো। হঠাৎ একটি অভিযানে বাবার গায়ে সন্ত্রাসী গ্রুপের একটি গুলি কপাল দিয়ে ঢুকে মগজ ভেদ করে পিছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাবার দাফনকাজ সম্পন্ন হয়। পুলিশ প্রশাসন থেকে বাবাকে মরণোত্তর সম্মানিত করা হয়। তারপর মা আমাকে নিয়ে গ্রামে চলে আসে। মাকে কখনো কাঁদতে দেখিনি। তবে প্রায়ই দেখতাম বাবার ব্যবহার করা জিনিসপত্র গুলো মা আলতো করে ছুঁয়ে দিতেন। চোখদুটো তখন কেমন বিষন্ন লাগতো! আমি ঐ সময়ে কখনোই মাকে বিরক্ত করতাম না। বাবার মৃত্যুর পর আমার খুব ভয় হতো। নিজেকে কেমন দুর্বল আর অসহায় লাগতো। তারপর ধীরে ধীরে আমার শক্তি হয়ে উঠে ঊষসী। রাত পেরিয়ে সকাল, সকাল পেরিয়ে দুপুর-সন্ধ্যে গড়িয়ে আবার রাত। মা, আমি আর ঊষসী। ঊষসী আমাকে নিমাই বলে ডাকতো। কেন ডাকতো জানিনা। জানতেও চাইনি। আমার ভালো লাগতো। তবে সবার সামনে ঊষসী আমাকে শুভ্র বলেই ডাকতো। তখন আমরা ক্লাস টেনে পড়ি। টেস্ট পরীক্ষা সামনে। পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত। ক্লাস, টিউশন, এক্সাম অনেক অনেক ব্যস্ততা। হঠাৎ একদিন টিউশনে ঊষসী অনুপস্থিত। পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় আর অভ্যেসগত কারণেই আমরা সবসময় একসাথেই স্কুলে আর টিউশনে যেতাম। কিছুদিন ধরে দীর্ঘদিনের এ অভ্যেসে ছেদ পরেছে। ঊষসীর বাড়িতে কাজ থাকায় ‘ও’ দেরিতে বের হতো। আমাকে বলতো- তুই যা আমি আসছি। আমি ভাবতাম ওর আবার কী কাজ? কিন্তু জিজ্ঞেস করা হয়নি পরীক্ষার টেনশনে। ফেরার পথে মন খারাপ করে থাকতো সারা রাস্তা। আমি ওকে বলতাম- সামনে পরীক্ষা তো কি হয়েছে। তুই খুব ভালো করবি। ঊষসী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতো। নিখুঁত মুখ ঠিক ওদের দুর্গার মতো। কিছু বলতো না। এভাবে আরো কিছু দিন কেটে যায়। হঠাৎ শুনি- ঊষসী এবার পরীক্ষায় বসবে না। আমি দৌড়ে ওদের বাড়িতে যাই। কাকীমা বললো- ঊষসী ঘুমায়। পরে আসিস। আমি বাড়ি চলে এলাম। আমার মন খারাপ দেখে মা জিজ্ঞেস করে- কী হয়েছে তোর? আমি ঊষসীর কথা বলি। মা জানায় আগামী মাসে ওর বিয়ে। তাই এবার পরীক্ষা দিবে না। এটা শুনে আমার কেমন যেন লাগে। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে নদীর ধারে চলে যাই। সারাদিন নদীর তীর ঘেঁষে হেঁটে বেড়াই। বাবার মৃত্যুর পর যেমন ভয় লাগতো। আজও আমার তেমন ভয় লাগছে। কেন? নিজেকে প্রশ্ন করি। কোন উত্তর পাইনি। তারপর ঊষসীর সাথে আমার আর দেখা হয়নি বেশ কিছুদিন। পাশের বাড়িতে বিয়ে। ধুমধাম শব্দ, পাড়ার লোকগুলো আমাদের উঠোন হয়ে দলবেঁধে ঊষসীকে দেখতে যায়। আমি ঘরে শিকল দিয়ে দিনরাত পড়াশোনা করছি। পাশের বাড়ির বিয়ের আয়োজনের শব্দ থেমে যায়। নীরবতায় স্থবির হয়ে পড়ে আমার চারপাশ। আমি আবার বোবা হয়ে যাই। আমি আবার দুর্বল, ভীরু হয়ে যাই।পরীক্ষা তখন শেষ। শীতের সকাল। উঠোনে বসে আছি। হঠাৎ একটি মাইক্রো বাস এসে থামে আমাদের উঠোন বরাবর রাস্তার পাশে। কয়েকজন লোক নেমে হাঁটতে শুরু করে প্রফেসর সাহেবের বাড়ির দিকে। আমার পিছনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে। পিছন ফিরে তাকাই। ঊষসী! শাড়ি, শাঁখা, সিঁদুর। এই সাজে প্রথম আমার চোখ ঊষসীকে দেখলো! আমার ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছে। কপাল কুঁচকে যাচ্ছে। কী বলব আমি! দুর্গার মতো ঊষসীর চোখের নিচে কালি, ভারাক্রান্ত মুখ, তৃষ্ণার্ত চোখ। সদা আমার প্রতি সদয় চোখ দুটো যেন আজ নিজেই বড্ড অসহায়। চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে নাকে। বিদ্যুৎ গতিতে আমার ডান হাত জড়িয়ে ধরে ওর তালুবন্দি করে। নিমাই, আমার নিমাই, কেন সেদিন আমাকে দেখতে এলি না? আমি হাজার জনের ভিড়ে শুধু তোকে খুঁজেছি। কেন এলি না? ঊষসী হাউমাউ করে কাঁদে। আমি ততক্ষণে বুঝতে পারি আমার চোখ ভিজে গাল বেয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে। আমি হাসার চেষ্টা করি। খুব করে চেষ্টা করি। তুই এমন শুকিয়ে গেছিস কেন, ঊষসী? তোর কপাল সিঁদুর ছাড়াই ভালো লাগে আমার। ঊষসী আমার চোখে তাকায়। সে কি উজ্জ্বল আর দীপ্ত চাহনি! আমি ঐ চোখের উজ্জ্বলতায় চোখ মিলাতে পারিনি। ঊষসী চলে যায়। আমি সাহস করে আর পিছন ফিরে তাকাইনি।তারপর পঁয়ত্রিশ বছর। আমাকে আর কেউ নিমাই বলে ডাকেনি। আজ কে আমায় নিমাই বলে ডাকলো? হয়ত ভুল, সত্যিই ভুল শোনার ভুল। বয়স হয়েছে তো! সামনে তাকিয়ে দেখি ভদ্রমহিলা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি বিব্রত বোধ করি। চোখ নামাই নিচে।
নিমাই।
আমার সমস্ত শরীর কাটা দিয়ে উঠে। ভুল নয়। এ ডাক সত্যি। তাকিয়ে দেখি ভদ্রমহিলার চোখ দুটো ভিজে।
আমাকে চিনিস নি নিমাই?
ঊষসী!
হুম।
কেমন আছিস?
আমি হতভম্ব। স্বপ্ন দেখছি না তো? সেই ঊষসী! কতদিন পর! হঠাৎ চোখ পড়ে ওর কপালে। কপালে সিঁদুর নেই। বুকটা মুচড়ে উঠে। হাতে তাকিয়ে দেখি সাদা শাঁখা দুটো ঝলঝল করছে। একজন পুলিশ সদস্য অনুমতি নিয়ে ভিতরে আসে। স্যার, অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রেন আসবে।
ঠিক আছে।
পুলিশ সদস্য বাইরে চলে যায়। আমি ঊষসীর দিকে তাকাই, চোখে হাজারটা জিজ্ঞাসা, মুখে কোনো শব্দ নেই। কেমন আছো তুমি, ঊষসী? তুমি এখনো দুর্গার মতই আছ। তোমার ট্রেন কখন? কোথায় যাবে?
ঊষসী আমার দিকে তাকায়- নিমাই, তুমি কী এখনো ভয় পাও? না, না, না। এখন তো তুমি পুলিশ পাহারায় চলো।
আমি কি বলব! শুধু তাকিয়ে আছি।
তুমি কি একা এসেছো?
ঊষসী মাথা নাড়ায়। না। আমার সাথে আমার স্বামী এসেছে। মেয়ের জরুরি কল আসায় বাইরে গেছেন।
তোমার মেয়ে? কোথায় সে? তোমার হাসবেন্ড কী করেন?
হু, সুইডেনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করছে। উর্বশীর বাবা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক।
আমি মাথা নাড়াই। তোমার মেয়ের নাম উর্বশী বুঝি, খুব ভালো। উঠতে হবে। ট্রেন এসে যাবে।
ঊষসী, তুমি কি সিঁদুর পরনা?
না, তুমি যেদিন বলেছিলে সিঁদুর ছাড়া আমার কপাল তোমার ভালো লাগে। তারপর আর কোনোদিন কপালে সিঁদুর তুলিনি।
আমি ঊষসীর চোখে তাকাই। আসি।
তোমার ছেলে-মেয়ে কয়জন, নিমাই?
আমি হাসার চেষ্টা করি। হয়নি।
মানে?
আমি বিয়ে করিনি। এই বলে আমি বেরিয়ে পড়ি।
ট্রেন ছেড়ে দেয়। নিমাই, আমার নিমাই, আওয়াজটা ভেসে আসে ট্রেনের ইঞ্জিনের শব্দ ভেদ করে। বাঁহাতে টিস্যুটা টেনে নিই।
এ বিভাগের আরো সংবাদ
© দেশ বুলেটিন 2023 All rights reserved
Theme Customized BY ITPolly.Com