অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এবং অস্ত্রধারি সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে এবার নড়েচড়ে বসেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ। জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধি ছাত্র আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর সিএমপির কার্যক্রমে প্রায় একমাস শিথিলতা দেখা দেয়। ফলে চট্টগ্রামের ১৬টি থানা এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে। ওই সময়ে আধিপত্য বিস্তারে সংঘর্ষের ঘটনাসহ, চুরি-ছিনতাই বেড়ে যায় আশঙ্কাজনকভাবে। এরপর ধীরে ধীরে প্রশাসন মাঠে নামতে শুরু করলেও পরিস্থিতি সামাল দেয়া ছিল পুলিশের পক্ষে কষ্টকর। গত ১৯ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) চট্টগ্রাম পরিদর্শন করে যাওয়ার পর পুলিশ বাহিনীতে সক্রিয়তা ফিরে আসে। ওইদিন দুপুরে স্বরাষ্ট্র ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নগরের দামপাড়া চট্টগ্রাম মেট্রেপলিটন পুলিশের (সিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের বলেন, বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিভাবে আরও উন্নতি করা যায় সে ব্যাপারে আলাপ হয়েছে। এ ব্যাপারে আপনাদের (সাংবাদিকদের) সাহায্য এবং সহযোগিতা চাই। পরিস্থিতির অবশ্যই উন্নতি হবে। পুলিশের মনোবল আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশের মিডিয়া মিথ্যা প্রচার করছে। আপনাদের কাছে অনুরোধ-মিথ্যা সংবাদ দিবেন না। এতে পার্শ্ববর্তী দেশ সুবিধা পেয়ে যায়। আমাদের দেশের মিডিয়ার যে একটা সুনাম আছে, পার্শ্ববর্তী দেশের মিডিয়ার কিন্তু কোনো সুনাম নাই। তারা মিথ্যাটাই প্রচার করে বেশি। আর এটা কিন্তু কাউন্টার করতে পারেন আপনারাই। সম্প্রতি পাকিস্তান থেকে আসা জাহাজ নিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এই জাহাজটা মিডল ইস্ট থেকে আসছে। সেখান থেকে এসে একটা দেশে গেছে সেখান থেকে আমাদের দেশে আসছে। আমাদের দেশে কোনো দেশের জাহাজ আসা নিষিদ্ধ আছে? আমরা কি কারো কাছে বন্দি যে শুধু তাকেই সেবা করবো? আমার দেশ সবার উপরে। খেজুর, পেঁয়াজ, আলু-এগুলো সামনের রোজার সময় দরকার। এগুলো কি আমরা আসতে দিবো না? যারা এগুলো রটাচ্ছে তারা আমাদের শত্রু। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোন সময় ভালো ছিল? আপনারা বলেন? এই যে একটি পূজা গেল, পূজাটি কতো সুন্দরভাবে হয়ে গেল। আজ আমরা একটি মতবিনিময় সভা করেছি। বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে তাদের সঙ্গে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিভাবে আরও উন্নতি করা যায় এ ব্যাপারে আলাপ হয়েছে। এ ব্যাপারে আপনাদের সাহায্য এবং সহযোগিতা চাই। পরিস্থিতির অবশ্যই উন্নতি হবে। যোগদান না করা পুলিশ সদস্যরা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা জয়েন করেনি তারা আমাদের চোখে ক্রিমিনাল। তাদের আইনের আওতায় অবশ্যই আনা হবে। জুলাই হত্যাকান্ডে চট্টগ্রামে অন্তত ৫০ জন অস্ত্রধারীকে চিহ্নিত রয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে সিএমপি শুধু একজন এবং র্যাব চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। বাকিদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এমনকি অস্ত্রও উদ্ধার করা যায়নি, সাংবাদিকের দেওয়া এমন তথ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পুলিশ কমিশনার ও র্যাবের অধিনায়ককে তাদের তালিকা করে গ্রেপ্তার করার তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেন। এ সময় পুলিশের আইজিপি ময়নুল ইসলাম, র্যাাবের ডিজি অতিরিক্ত আইজিপি একেএম শহিদুর রহমানসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। স্বরাষ্ট্র ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.)-এর উপরোক্ত নির্দেশনার পরথেকে চট্টগ্রাম পুলিশ বাহিনীতে অনেকটা সক্রিয়তা বেড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সচেতন মহল। এরপর থেকে একের পর গ্রেপ্তার হচ্ছে, নানা অপরাধি। এরই অংশ হিসেবে শনিবার (২৩ নভেম্বর) চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি বর্ষণকারী যুবলীগ কর্মী তৌহিদুল ইসলাম ওরফে ফরিদকে (৩২) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পুলিশ বলছে, ছাত্র-জনতার ওপর একাই ২৮টি গুলি ছোড়েছেন তৌহিদুল। শুক্রবার রাতে সাতক্ষীরা জেলার কমলনগর এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) চান্দগাঁও থানার পুলিশ। গ্রেপ্তার তৌহিদ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ৪নং চান্দগাঁও ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর এসরারুল হকের অনুসারী হিসেবে এলাকায় পরিচিত। তৌহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে ৫টি হত্যাসহ অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি মাদক ও ছিনতাইয়ের ১২টি মামলা রয়েছে। তিনি নগরের চান্দগাঁও থানাধীন শমশের পাড়ার বড় পুকুরপাড় এলাকার মনু সওদাগর বাড়ির মো. সেকান্দরের ছেলে। গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি) কমিশনারের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে উপ-কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) মো. রইছ উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে সাতক্ষীরা থেকে তৌহিদুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণের কথা স্বীকার করেন। তার বিরুদ্ধে পাঁচটি হত্যাসহ ১২টি মামলা রয়েছে। মো. রইছ উদ্দিন আরও বলেন, তার ব্যবহৃত অস্ত্রটি পাকিস্তানি শুটারগান এবং তার কাছে একাধিক অস্ত্র রয়েছে। তার ব্যবহৃত এই অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করতে আমাদের অভিযান চলমান আছে। তৌহিদুলের রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়নি। তবে তিনি একজন পেশাদার সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারী। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ৫টি হত্যাসহ অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি মাদক ও ছিনতাইয়ের ১২টি মামলা রয়েছে। চান্দগাঁও থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আজহারুল ইসলাম বলেন, বৈষম্যবিরোধি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তৌহিদুল একটি শাটার গান নিয়ে গুলিবর্ষণ করেন। গত ১৮ জুলাই নগরের বহদ্দারহাট এলাকায় তৌহিদুল একাই ২৮টি গুলি ছোড়ার কথা স্বীকার করেছেন। ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্রটি উদ্ধারে অভিযান চলছে। উল্লেখ্য, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ১৭ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত চট্টগ্রামে গুলিতে নিহত হন ১০ জন। আহত হন শতাধিক। এই ঘটনায় নিহত ব্যক্তির পরিবার ও স্বজনেরা নগরের বিভিন্ন থানা ও আদালতে অন্তত ২৫টিরও বেশি মামলা করেছে। এছাড়া শনিবার একইদিন পাহাড়তলী থানা পুলিশ পাঁচ কেজি গাজাসহ এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশ জানায়, থানার দুলালাবাদস্থ পাহাড়তলী থানার মূল গেইটের বিপরীতে চেকপোষ্ট পরিচালনা করে একটি সিএনজি ট্যাক্সি থামিয়ে যাত্রীর কাধ ব্যাগ তল্লাশী করে ৫ কেজি গাজাসহ মো. ফারুক (৪২) কে গ্রেপ্তার করে। এছাড়া আরো বিভিন্ন থানায় বিভিন্ন অপরাধে একাধিক জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে নগর পুলিশ। এ প্রসঙ্গে সিএমপির উপ-কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) মো. রইছ উদ্দিন বলেন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ তথা অপরাধি গ্রেপ্তারে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে অভিযান আরো জোরদার করা হয়েছে বলে জানান তিনি।