কারো ওপর অসন্তুষ্ট হলে কিংবা কোনো প্রকল্পে নিজের পছন্দের লোককে নিয়োগ না করা হলেই ডেকে এনে নির্যাতন করতেন। অকথ্য ভাষায় গালাগাল সহ করতেন শারীরিক নির্যাতন। আর এমপির আদেশে অধিকাংশ সময় নির্যাতন করতেন তার ভাতিজা পারভেজ ও ফিরোজনীলফামারী ১ (ডোমার -ডিমলার) সাবেক এমপি আফতাব উদ্দিন সরকারের ১৬ বছর ধরে মানুষকে এভাবেই জিম্মি করে রেখেছিলেন। তার বিরুদ্ধে কথা বললেই চলত মামলা হামলা। বিরোধী দল এবং ভিন্ন মতাদর্শের আওয়ামী লীগের কর্মীদের শায়েস্তা করার জন্য তৈরি করেছিলে টর্চার সেল। তাছাড়া দুই উপজেলা জুড়েই তার নেতৃত্বে গড়ে উঠে আগুন খাওয়া টিম। এই আগুন খাওয়া টিম এর নিয়ন্ত্রণ করতেন তার দুই ভাতিজা যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক ফেরদৌস পারভেজ এবং উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহবায়ক এইচ এম ফিরোজ। এই বাহিনীর মাধ্যমে দুই উপজেলায় ত্রাস এবং সন্ত্রাসের মাধ্যমে ভয়ের রাজত্ব কায়েম করে রাখতেন রাজনীতিতে উত্থান ১৯৫০ সালে জন্ম নেওয়া আফতাব উদ্দীন সরকার ১৯৭৩ সালে প্রথম সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। কথিত আছে ১৯৮৭ সালে প্রথম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কারচুপি ও ভোটকেন্দ্র দখলের মাধ্যমে প্রথম উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৯৭ সালে ডিমলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। প্রায় দুই যুগের বেশি সময় একই পদে বহাল ছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে আবারো ভোট কারচুপির মাধ্যমে উপজেলা চেয়ারম্যান হন। এরপর আর তাকে পেছনে ফেরে তাকাতে হয়নি। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েই বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমন পীড়ন জন্য তৈরি করেন ক্যাডার বাহিনী যা আগুন খাওয়া বাহিনী নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে রাতের আধারে হওয়া ভোটের মাধ্যমে ২য় বারের মতো সংসদ নির্বাচিত হয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেন আফতাব বিরোধী দলে পাশাপাশি নিজ দলীয় ভিন্ন মতাদর্শের ব্যক্তিদের নির্যাতন শুরু করেন। তৈরি করেন এমপি লীগ। কেও এমপির বিরোধিতা করলেই মামলা হামলা করে অমানুষিক নির্যাতন করতেন। ২০২৪ সালে ৩য় বারের মতো এমপি নির্বাচিত হলেও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে তিনিও জীবন বাচাতে আত্মগোপনে চলে যান।মনোনয়ন বাণিজ্যস্থানীয় সরকার নির্বাচনের মনোনয়ন বানিজ্যের পুরো নিয়ন্ত্রণ করতেন আফতাব। তার কথাই চুড়ান্ত বলে বিবেচিত হতো। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাইয়ে দিতে নিতেন ২৫-৩০ লক্ষ টাকা। নির্বাচনের আগে নৌকা এবং আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের কাছে থেকে দোয়া করার কথা বলে নিতেন ৩-৫ লক্ষ টাকা। পছন্দের ব্যক্তিকে নির্বাচিত করার জন্য প্রশাসনের উপর চাপ প্রয়োগ করে নিজস্ব গুন্ডা বাহিনী দিয়ে ভোটকেন্দ্র দখল সহ জাল ভোট প্রদানেও হাত ছিল তার। আশীর্বাদ পৃষ্ঠ হলেই নির্বাচনে জয় আর না হলেই হেরে যাওয়ার ভয় ছিলো প্রত্যেক প্রার্থীর। নিজের ভাতিজা ও ভাগিনাকে প্রভাব খাটিয়ে করেছেন ইউনিয়ন চেয়ারম্যান। ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ দলীয় নেতাকর্মী ও ঠিকাদারির জড়িত অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডিমলা ও ডোমার উপজেলার প্রত্যেকটি উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতেন তার ভাতিজা পারভেজ। এমপির হয়েই তিনি এই কাজ সম্পন্ন করতেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন প্রকল্পের কোন কাজ কে পেতেন সেটাও ঠিক করে দিতেন এমপি। উন্নয়ন পত্রের দরপত্র বণ্টন ও কমিশন আদায়ের দায়িত্ব ছিলো পারভেজের উপর। তিনি প্রকল্প ভেদে ৭-১০ শতাংশ আদায় করতেন। নাম প্রকাশ না করা শর্তে এলজিইডির এক কর্মকর্তা বলেন, যে কোনো প্রকল্প আসলেই পারভেজ ঠিক করে দিতেন কে কোন প্রকল্প পাবে। তাছাড়াও যেসব প্রকল্প অনলাইনের মাধ্যমে টেন্ডার হতো সেই প্রকল্প গুলো অন্য কেও পেলে তাদের কাজে বাধা দিতো পারভেজ ও তার দলবল। ফলে বছরের পর বছর ঐ সকল প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকতো। পারভেজের সাথে সমযোতা হলেই আবার কাজ চালু হতোমাদকদ্রব্য ও চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ ভারতীয় সীনান্তবর্তী উপজেলা হওয়ায় সহজেই বাংলাদেশে ভারত থেকে মাদকদ্রব্য ও ভারতীয় পণ্য চোরাচালান হতো। আর এই চোরাচালানের পুরো সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ ছিলো এমপি আফতাব উদ্দীনের হাতে। তার হয়ে মাদকের চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করতেন তার ভাতিজা উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক আবু সায়েব সরকার৷ মাদক চোরাচালানের জন্য মাদক সম্রাট হিসেবে রয়েছে উপজেলাজুড়ে তার ব্যাপক পরিচিতি ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় রাতের আঁধারে ভারত সীমান্ত থেকে ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইনসহ নিষিদ্ধ নেশাজাতীয় দ্রব্য চোরা-চালান করতেন। এই চোলাচালানের অর্থের ভাগ সময়মতো চলে যেতো এমপির কাছে। ভারতীয় গরু ও পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের চোরাচালান সহজ করে দিয়েছিলেন সাবেক এই সাংসদ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চোরাকারবারি বলেন, ভারত থেকে গরু পাচারের জন্য এমপি আফতাবকে প্রত্যেক গরু বাবদ ১০-১৫ হাজার টাকা করে দিতে হতো। টাকা না দিয়ে কেও ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে গরু কিংবা অন্য কোনো পণ্য চোরাচালান করতে পারতো না। এমপির কথার অবাধ্য হলেও আগুন টিমের মাধ্যমে চলতো অমানুষিক নির্যাতন। মিথ্যা মামলা দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া হতো। বর্তমানে আত্মগোপনে থাকায় এইসব অভিযোগের বিষয়ে আফতাব উদ্দীন সরকার ও তার ভাতিজা ফেরদৌস পারভেজের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।