যশোরের তানজীমুল উম্মাহ প্রি–হিফয মাদরাসায় শিক্ষার্থী রাইয়ানকে নির্যাতনের ঘটনায় শিক্ষক আব্দুস সামীরকে বরখাস্ত ও বহিষ্কার করার পর এখন উল্টো অভিভাবক রাসেল আহমেদের বিরুদ্ধেই ‘এক কোটি টাকার চাঁদা দাবির’ অভিযোগ তুলেছে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। এই অভিযোগকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার বলে দাবি করে রাসেল বলেন, তাঁর সন্তানকে হাসপাতালে নেওয়া থেকে শুরু করে এক্স–রে করানো পর্যন্ত সবকিছুই মাদরাসার লোকজন করেছে। অথচ এখন নির্যাতনের ঘটনা আড়াল করতে তাঁকেই চাপে ফেলার চেষ্টা চলছে।
ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর শিশুটির ওপর নির্মম নির্যাতনের অভিযোগে শিক্ষক আব্দুস সামীরকে আটক করে পুলিশ। পরে তাঁকে আদালতে হাজির করলে আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বর্তমানে এই পাষাণ শিক্ষক যশোর জেলা কারাগারে রয়েছেন, এবং তাঁর বিরুদ্ধে শিশু নির্যাতন আইনে মামলা চলমান।
১২ নভেম্বর সকালে মাদরাসার ভেতরে শিক্ষক আব্দুস সামীরের হাতে রাইয়ান আহত হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, শিক্ষক শিশুটিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন এবং শারীরিকভাবে আঘাত করছেন। এরপর শিশুটিকে হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং সমালোচনার মুখে শিক্ষককে বরখাস্ত করে মাদরাসা। স্থানীয় সাংবাদিকেরা অভিভাবক, প্রত্যক্ষদর্শী, হাসপাতাল ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে ঘটনাটি প্রচার করেন। কয়েকটি প্রতিবেদনে শিশুদের জন্য ‘টর্চার সেল’-এর মতো অভিযোগও উঠে আসে, যা দেশব্যাপী আলোচনার জন্ম দেয়।
ঠিক এই সময়েই মাদরাসার পক্ষ থেকে প্রচার করা হয় নতুন দাবি—শিশুটি নাকি অসাবধানতাবশত পড়ে গিয়ে হালকা আঘাত পেয়েছিল, তার হাতে কোনো ভাঙন ছিল না, বরং অভিভাবকরা নাকি এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। বিবৃতির সঙ্গে তারা একটি মেডিকেল রিপোর্টও পাঠায়। রাসেল আহমেদ বলেন, “আমি আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ, তার মানসিক অবস্থা, চিকিৎসা আর পড়াশোনার ক্ষতির কথা বিবেচনা করে মাদরাসার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। সেখানে কিছু আনুমানিক হিসাব ছিল, মানবিকভাবে। পারিবারিক ব্যয় মওকুফের প্রস্তাবও তারা দিয়েছিল। কিন্তু সেই কথাকেই এখন চাঁদা দাবি হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছে—এটা সম্পূর্ণ অসৎ উদ্দেশ্য।”
রাসেল জানান, তাঁর আত্মীয় পিয়াল ও মাহমুদ শিশুটির খোঁজ নিতে মাদরাসায় গিয়েছিলেন। অথচ বরখাস্ত হওয়া শাখা প্রধান সাইফুর রহমান দাবি করছেন—ঘটনাটি বড় করে দেখানোর পেছনে এই দুজনের ভূমিকা আছে। রাসেল বলেন, “তারা আমার আত্মীয়, শিশুটির খবর নিতে গিয়েছে। কোনো রাজনৈতিক বা আর্থিক উদ্দেশ্যের কথা বলা সম্পূর্ণ মিথ্যা।” তিনি চাঁদা দাবির অভিযোগের বিষয়ে ইতোমধ্যেই কোতোয়ালি থানায় অবগতি দিয়েছেন।
অন্যদিকে স্থানীয় সাংবাদিকেরা বলছেন, ঘটনা প্রকাশের আগেই শিক্ষক বরখাস্ত করা, শিশুকে হাসপাতালে নেওয়া—এসব তথ্য প্রতিষ্ঠান নিজেরাই নিশ্চিত করেছে। এখন উল্টো সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, যা তাঁরা অযৌক্তিক বলে মনে করছেন। তাঁদের ভাষ্য, “পুরো ঘটনাকে অন্যদিকে ঘোরাতে গণমাধ্যমকে দায়ী করা হচ্ছে—এটা দুঃখজনক।”
থানার দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, শিশুর আহত হওয়ার ঘটনা ও শিক্ষক বহিষ্কার—অপরাধে জেল হাজতে প্রেরণ উভয়ই সত্য। অভিভাবক ও মাদরাসার পক্ষ থেকে পৃথক অভিযোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজসহ সব দিক তদন্তে দেখা হচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, নির্যাতন ধামাচাপা দেওয়ার প্রবণতা শিশুদের প্রতি সহিংসতা বাড়িয়ে দেবে। তাই নির্যাতনকারী শিক্ষক ও বিভ্রান্তি ছড়ানো ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা জরুরি।
স্থানীয়দের মতে, নির্যাতনের পর শিক্ষক বরখাস্ত করা, পরে আবার শিক্ষককে নির্দোষ দাবি করা, অভিভাবকের বিরুদ্ধে চাঁদা দাবির অভিযোগ তোলা—এসব ঘটনাই বোঝায় যে বিষয়টি অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা চলছে। তাঁরা মনে করেন, পুলিশের তদন্তেই শেষ পর্যন্ত প্রকৃত সত্য স্পষ্ট হবে।