পঞ্চগড়-২ (বোদা-দেবীগঞ্জ) আসনকে ঘিরে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে তৈরি হয়েছে ভিন্নধর্মী এক সমীকরণ। প্রচলিত দলগুলোর ভেতরে ভাঙন, নতুন শক্তির উত্থান এবং ব্যক্তিনির্ভর জনপ্রিয়তার কারণে এ আসনে লড়াই অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। স্থানীয় ভোটাররাও আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন—কোন শক্তি শেষ পর্যন্ত বিজয়ের হাসি হাসবে।
বিএনপি: ঐক্যের সংকটে সবচেয়ে বড় ক্ষতি
পঞ্চগড়-২ আসনে বিএনপির দীর্ঘদিনের শক্ত ভোটব্যাংক রয়েছে। কিন্তু এবার দলটি কার্যত পাঁচ ভাগে বিভক্ত।
বিএনপির পল্লী উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক ফরহাদ হোসেন আজাদ,জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সহ- সভাপতি মাসুদ রানা রিয়াজ,বিএনপি দেবীগঞ্জ উপজেলার বহিস্কৃত আহবায়ক রহিমুল ইসলাম বুলবুল,জোটের পক্ষ থেকে আমির হোসেন আমু ও বিএনপি মোজাহার গ্রুপের মুকুল বকসী।
এই পাঁচটি শিবিরে বিভক্ত হওয়ায় নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা এবং ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। একজন স্থানীয় ব্যবসায়ী বলেন, “বিএনপির এত শিবির, কার প্রতি আস্থা রাখব বুঝতে পারছি না। বিভক্ত থাকলে তাদের জয়ের সম্ভাবনা কম।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপি যদি শেষ মুহূর্তে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে, তবে এ আসনে তাদের ঐতিহ্যগত শক্তি কার্যত ভেঙে পড়বে।
জাসদ: অতীতের দায়ে ভারাক্রান্ত
বাংলাদেশ জাসদের প্রার্থী হচ্ছেন এমরান আল আমিন। তবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। ফলে তৃণমূল পর্যায়ে তাকে ঘিরে এক ধরনের নেতিবাচক আলোচনা চলছে। যদিও জাসদের সাংগঠনিক উপস্থিতি কিছুটা আছে, তবে স্থানীয় ভোটারদের বড় অংশ মনে করেন—এই নির্বাচনে জাসদ বড় কোনো চমক দেখাতে পারবে না।
জামায়াত: ব্যক্তিগত ভাবমূর্তির ভরসা
জামায়াত এবার একক প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে সফিউল্লাহ সুফিকে। তিনি এলাকার একজন পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির রাজনৈতিক কর্মী। স্থানীয়ভাবে ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও দলীয় সংগঠন দুর্বল।
একজন প্রবীণ শিক্ষক বলেন, “সুফি সাহেব ভালো মানুষ, তবে শুধু ভালো মানুষ হলেই তো নির্বাচন জেতা যায় না। সংগঠনের শক্তি দরকার।”
বিগত নির্বাচনগুলোতে জামায়াতের ভোটের কাস্টিং সীমিত ছিল। এবার সুফির ভাবমূর্তি কিছুটা সহায়ক হতে পারে, তবে দলীয় ভিত্তি দুর্বল হওয়ায় তারা কতদূর যেতে পারবে তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে।
এনসিপি: নতুন শক্তির উত্থান
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে মাঠে নামছে। এ আসনে দলের সম্ভাব্য প্রার্থী তরুণ রাজনীতিবিদ ও বোদা উপজেলা প্রধান সমন্বয়কারী শিশির আসাদ।
তিনি এলাকায় স্মার্ট, মিশুক এবং তরুণমুখী নেতৃত্ব হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের কাছে তার জনপ্রিয়তা বাড়ছে। একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র বলেন, “পুরোনো দলগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা কমেছে। নতুন মুখ, নতুন দল—তাই শিশির ভাইয়ের প্রতি আমাদের আগ্রহ।”
তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এনসিপি এখনো পুরোপুরি সাংগঠনিকভাবে নির্বাচনমুখী হতে পারেনি। সংগঠনকে শক্তিশালী করতে না পারলে তরুণদের এই উচ্ছ্বাস ভোটে রূপ নেবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন।
ভোটারদের সমীকরণ
বোদা ও দেবীগঞ্জের গ্রামীণ অর্থনীতি, কৃষি নির্ভর জীবনযাত্রা এবং তরুণ ভোটারের আধিক্য এবার নির্বাচনে বড় প্রভাব ফেলবে। ভোটাররা বলছেন, উন্নয়ন, কর্মসংস্থান এবং সৎ নেতৃত্ব—এই তিনটি বিষয়ই তাদের প্রধান বিবেচনা।
একজন কৃষক জানান, “কোনো দল বা নেতা নয়, আমরা চাই উন্নয়ন। রাস্তাঘাট হোক, কৃষিপণ্যের দাম পাই—এইটাই চাই।”
সার্বিক বিশ্লেষণ
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, এ আসনের মূল লড়াই জমে উঠবে বিএনপির বিভক্ত শিবির, জামায়াত এবং এনসিপির মধ্যে।
বিএনপির ঐতিহ্যবাহী ভোটভিত্তি থাকলেও বিভাজন তাদের বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে।
জামায়াত প্রার্থী সফিউল্লাহ সুফির ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা কিছুটা সুবিধা দেবে, তবে সংগঠনের দুর্বলতা বড় চ্যালেঞ্জ।
এনসিপির তরুণ প্রার্থী শিশির আসাদ নতুন নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে ভোটারদের দৃষ্টি কাড়ছেন, যদিও তাদের সাংগঠনিক ঘাটতি স্পষ্ট।
জাসদ এখানে তুলনামূলকভাবে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে।
ফলস্বরূপ, পঞ্চগড়-২ (বোদা-দেবীগঞ্জ) আসনে নির্বাচনী লড়াই অনিশ্চয়তায় ভরপুর। শেষ মুহূর্তে প্রার্থীদের অবস্থান এবং দলীয় কৌশলই নির্ধারণ করবে, কে হবেন এ অঞ্চলের আগামী দিনের প্রতিনিধি।
পঞ্চগড় -২ আসনে ভোটার সংখ্যা
পঞ্চগড়-২ আসনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার ছিল ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৯৪১। এদের মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৯৫ হাজার ৭১০ ও নারী ভোটার ১ লাখ ৯৪ হাজার ২২৮ এবং তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) ভোটার ছিলেন তিনজন। তবে হালনাগাদ তালিকায় মৃত ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার পর এ আসনে ভোটার বেড়েছে ১৩ হাজর ২৬৭। এদের মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভোটার এক লাখের বেশি। তরুণ ভোটার ২৫ থেকে ৩০ হাজারের মতো।