বাংলাদেশ জুড়ে কোরবানির ঈদের আনন্দের মাঝেও যে সরীসৃপটি মানুষের ভেতরে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে সেটির নাম ” রাসেল’স ভাইপার”। চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া নামেও এটি পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম Daboia russelii. এটি কর্ডাটা পর্ব ও Reptilia শ্রেণির সরীসৃপ প্রাণি। সম্প্রতি বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে এই বিষধর সাপের আনাগোনা বেড়েছে। এর কামড়ে বেশ কিছু প্রাণহানির ঘটনা ঘটায় আতঙ্ক ছড়াচ্ছে দেশ জুড়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর অন্তত পাঁচ লাখ আঁশি হাজার মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন এবং এদের মধ্যে ছয় হাজার মানুষ মারা যায়।
চন্দ্রবোড়ার দেহ মোটাসোটা, লেজ সরু ও ছোট। প্রাপ্ত বয়স্ক সাপের দেহের দৈর্ঘ্য সাধারণত এক মিটার। দেহের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ১.৮ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এদের মাথা চ্যাপ্টা, ত্রিভুজাকার এবং ঘাড় থেকে আলাদা। চোয়াল ভোঁতা, গোলাকার ও উত্থিত এবং নাসারন্ধ্র বড়। চন্দ্রবোড়ার শরীর লেজসহ সর্বোচ্চ ১৬৬ সেমি (৬৫ ইঞ্চি) পর্যন্ত বৃদ্ধি পায় এবং এশিয়ার মূল ভূখন্ডে গড়ে প্রায় ১২০ সেমি ( ৪৭ ইঞ্চি) পর্যন্ত হয়ে থাকে।
রাসেল’স ভাইপার সাধারণত ঘাস, ঝোপ-ঝাড়, ও ফসলের ক্ষেতে বিশেষত নিচু জমির ঘাসযুক্ত উন্মুক্ত ও কিছুটা শুষ্ক পরিবেশে বাস করে। স্থলভাগের সাপ হলেও এরা পানিতে দ্রুত গতিতে চলতে পারে। ফলে বর্ষাকালে কচুরিপানার সঙ্গে বহুদূর পর্যন্ত ভেসে নিজের স্থানান্তর ঘটাতে পারে। বসতবাড়ির আশেপাশে চন্দ্রবোড়ার খাবারের প্রাচুর্যতা বেশি থাকায় খাবারের খোঁজে অনেক সময় লোকালয়ে চলে আসে।
রাসেল’স ভাইপার প্রচন্ড আক্রমনাত্মক হয়ে থাকে। প্রতি বছর পৃথিবীতে যত মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায় তার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ এই চন্দ্রবোড়ার দংশনে মারা যায়। এদের বিষদাঁত বৃহৎ এবং এরা প্রচন্ড জোরে হিস হিস শব্দ করতে পারে। অন্য প্রজাতির সাপ মানুষকে কামড়ানোর পর সেখান থেকে দ্রুত সরে যায়, কিন্তু রাসেল’ স ভাইপার ঘটনাস্থল থেকে সরতে চায় না। অন্য প্রজাতির মানুষকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলেও এ প্রজাতির সাপের স্বভাব বিপরীত। তাই প্রতি বছরই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ কেবল এই প্রজাতির সাপের কামড়ে প্রাণ হারান। আক্রমণের ক্ষিপ্র গতি ও বিষের তীব্রতার কারণে ” কিলিং মেশিন” হিসেবে বদনামও রয়েছে এই প্রজাতির।
রাসেল’স ভাইপারের বিষ হেমাটোটক্সিক, যার কারণে কামড় দিলে মানুষের মাংস পঁচে যায়। এর বিষ ফুসফুস, কিডনি নষ্ট করে দেয়ার মতো বিভিন্ন জটিলতা তৈরি করে। লুপাস অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্ট নামে গর্ভপাতকারী এক রোগ নির্ধারণের পরীক্ষায় ( ডাইলিউট রাসেল ভাইপার ভেনম টাইম টেস্ট) চন্দ্রবোড়ার বিষ ব্যবহৃত হয়।
রাসেল’স ভাইপারের অবস্থান :
পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন জেলা বিশেষ করে নদীয়া, বর্ধমান, উত্তর চব্বিশ পরগনা সহ বেশ কয়েকটি জেলায় দেখা যায়। আগে শুধুমাত্র বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে দেখা গেলেও বর্তমানে তা পদ্মা নদীর তীরবর্তী জেলা ও চরসমূহে বিস্তার লাভ করেছে।
চিকিৎসা :
রাসেল’স ভাইপারের বিষকে কার্যকরভাবে নিরপেক্ষ করতে অ্যান্টিভেনম যথেষ্ট।
রাসেল’স ভাইপার ভেনম ( RVV) ফ্যাক্টর এক্সকে সক্রিয় করে যা ফ্যাক্টর V, প্রোথেম্বিন, ফসফোলিপিড এবং ক্যালসিয়াম আয়রনের উপস্থিতিতে ফাইব্রিন ক্লট সৃষ্টি করে।
রাসেল’স ভাইপারের কামড়ে কেউ আক্রান্ত হলে কোনো অবস্থাতেই ওঝার কাছে যাবেন না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। এরা শতকরা ৯৯% কামড়েই বিষ প্রয়োগ করে। তাই কামড়ানোর পরবর্তী ১০০ মিনিট সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের মধ্যে অ্যান্টিভেনম পুশ করলে বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা ৯৯%। রাসেল’স ভাইপার জাতীয় সাপ হেমোটক্সিন বিষধারী যা রক্তের উপর প্রভাব বিস্তার করে। রক্ত জমাট বাঁধতে না পারায় অনবরত ক্ষরিত হয়। তাই এ জাতীয় সাপের কামড়ে একদমই বাঁধন দেওয়া যাবে না। তা না হলে মাংস পচন ধরা আরো সহজ হয়ে যাবে।
কিছু পূর্ব সচেতনতা মেনে চললে রাসেল’স ভাইপারের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে :
১। পরে থাকা পুরাতন গাছ বা যেকোন গাছের নিচে খেয়াল না করে হাত দেবেন না বা বসবেন না।
২। সবজি ক্ষেতে কাজ করার সময় বা ধানসহ যেকোন ফসল কাঁটার সময় গামবুট ব্যবহার করবেন।
৩। সাপ থাকতে পারে এরকম জায়গায় প্রবেশ করার আগে জোরে শব্দ হয় এমন কিছু দিয়ে প্রচন্ড শব্দ করবেন যেন সাপ থাকলে ভয়ে পালিয়ে যায়।
৪। এরা খুবই হিংস্র প্রকৃতির, তাই যেসব এলাকায় বেশি দেখা যায় সেসব এলাকায় সাবধানে চলাফেরা করতে হবে।
৫। কখনো সাপের উপস্থিতি টের পেলে সামনে থেকে সরে গিয়ে নিরাপদ দুরত্ব বজায় রাখতে হবে।