বরিশালে কিশোর গ্যাং এর তৎপরতা সেই ২০২০ সালে ই প্রকাশ্যে আসে। সেবার দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত একটি খবরে কথিত ‘আব্বা গ্রুপ’ এর বেশ কিছু অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সহ অনেক সদস্যের নাম পরিচয় ও উঠে এসেছিল।
সেই থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বরিশাল নগরীতে কিশোর অপরাধের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে। বিভিন্ন সময় প্রশাসনের বিভিন্ন তদারকি সত্বেও কোনভাবেই যেন থামানো যাচ্ছে না কিশোর গ্যাং এর অপতৎপরতা। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে কিংবা সড়ক মহাসড়কের মোড়ে, আবার অলিতে গলিতে এদের আড্ডা বাজি সবসময়ই ভীত সন্ত্রস্ত করে রাখে ওই সকল এলাকার সাধারণ নাগরিকদের।
এলাকা ভিত্তিক বিভিন্ন নামে গড়ে উঠেছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব কোরাম। দ্রুত এদের লাগাম টানা না হলে যে কোন সময় ঘটতে পারে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত অপরাধমূলক ভয়ঙ্কর ঘটনা।
কখনো দলীয় ছত্রছায়ায় আবার কখনো স্হানীয় নেতাদের নাম ভাঙিয়ে কিশোর গ্যাং এর সদস্যরা নগরীতে গড়ে তুলছে নানা অপরাধ মূলক কর্মকাণ্ড। এদের বেশিরভাগই স্কুল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী। যাদের বয়স ষোলো থেকে চব্বিশ- পঁচিশ বছর।
সামাজিক পর্যটন স্থানগুলোতে মেয়েদের ছবি তোলা, ভিডিও করা সহ নানান ভাবে উত্ত্যক্ত করছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। নগরীজুড়ে বিকট আওয়াজ এ মোটরসাইকেলের মহড়া, মেয়েদের ইভটিজিং ও চুরি-ছিনতাই এদের নিত্যদিনের কাজ। ঘুরতে যাওয়া মানুষদের ছবি তুলে ব্লাকমেইল করা আরো কতো কি। আর এখানেই ক্ষান্ত নয় তারা।
বরিশাল নগরীর অলি-গলিতে মাদকের বিষ ছড়াচ্ছে এই কিশোর গ্যাং এর সদস্যরা। প্রায় সকল স্হানের মাদক ব্যাবসার সাথে জড়িত এসব কিশোর গ্যাং। বিভিন্ন সময়ে এদের অনেকেই গ্রেপ্তার হলেও টাকা ও প্রভাব খাটিয়ে জামিনে বের হয়ে আবারও করতে দেখা যায় একই ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ড।
বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন অদ্ভুত নামের গ্রুপ খুলে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি এই গ্রুপগুলো মাদকের সিন্ডিকেট ও চালিয়ে যাচ্ছে এই সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে।
কিছু দিন আগে গড়িয়ারপার এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা ছিনতাই করলে খবর পেয়ে বরিশাল বিমান বন্দর থানা পুলিশ কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য নুরুল হাজি (১৭), মো. মারুফ(১৬), অগ্রজিত (১৭), নামের তিনজনকে তাৎক্ষণিক আটক করে। এরা সকলেই ভয়ংকর কিশোর গ্যাং এর সদস্য।
বঙ্গবন্ধু উদ্যানে ঘুরতে গিয়ে কটূক্তির প্রতিবাদ করে কিশোর অপরাধীদের হামলার শিকার হয়েছিলেন এক পুলিশ সার্জেন্টের স্ত্রী। এসময় কিশোর অপরাধীরা গাজা সেবন সহ আরো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটায়। এ ঘটনায় সার্জেন্টের স্ত্রী ‘কিশোর গ্যাং’য়ের ২৫ সদস্যের বিরুদ্ধে বিএমপি’র কোতয়ালী থানায় মামলা করার পরে একজনকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। ১৬ বছরের ওই কিশোর নগরীর কেডিসি আব্দুর রাজ্জাক কলোনির বাসিন্দা।
এরই মধ্যে একই স্হানে প্রকাশ্যে সিগারেট খেতে নিষেধ করায় কিশোর অপরাধীদের কাছে একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ভদ্রলোকের অপমানিত ও হেনস্থা হবার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও ছড়িয়ে পড়েছিল।
সর্বশেষ গত ২৩ মার্চ মোবাইলে জুয়া খেলার টাকা নিয়ে দন্দ্বে বরিশাল নগরীর বান্দরোডে কিশোর গ্যাং এর হামলা পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে দোকান কর্মচারী তানিম ও আসিফ আহত হয়। পুলিশ হামলাকারী রায়হান ও অন্তর নামে দুইজনকে আটক করেছে। এরা সকলেই ভয়ংকর কিশোর অপরাধী।
তাদেরকে রোববার (২৪ মার্চ) দুপুরে দায়েরকৃত একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।
এরা হলো- ঝালকাঠির নলছিটি এলাকার বাসিন্দা ও নগরীর মেডিকেল কলেজ লেন এলাকায় অস্হায়ী বসবাসরত বজলু মিয়ার ছেলে রায়হান (১৫) এবং মিরাজের ছেলে অন্তর(১৪)। এরা উভয়েই ঐ এলাকার ভারাটিয়া।
জানা গেছে, গ্রেপ্তারকৃতরা স্থানীয় প্রভাবশালী মাদক (ইয়াবা) সম্রাট সিয়াম সহ আরো কয়েকজন শীর্ষ স্হানীয় কিশোর অপরাধীর নাম ভাঙ্গিয়ে মেডিকেল কলেজ লেন, বান্দরোড ও শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে সারাদিন মোবাইলে জুয়া খেলা, মাদক সেবন, প্রকাশ্যে মাদক বেচাকেনা ও ইভিটিজিং করা, সংরক্ষিত পুকুরের মাছ জোর পূর্বক ধরে বিক্রি করা, অবৈধ ভাবে ক্যাম্পাসে ভাসমান দোকান বসিয়ে ভাড়া দেয়া, চাঁদা তোলা সহ একটি ভয়ংকর কিশোর অপরাধী গ্রুপের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলো।
এলাকায় নিজেদের আধিপত্য দেখাতে প্রায়ই এরা দেশীয় ধারলো অস্ত্র নিয়ে শো-ডাউন দেয়া সহ নানা রকম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতো।
এর ই ধারবাহিকতায় গত (শনিবার) ২৩ মার্চ রাতে রায়হান ও অন্তরের নেতৃত্বে দোকান কর্মচারী তানিম ও অপর এক কিশোর আসিফের ওপর হামলা করা হয়। পরে কোতয়ালী মডেল থানায় তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে মধ্যরাতে মেডিকেল কলেজ লেন এলাকার রায়হান ও অন্তরের ভাড়া করা বাসায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
কিশোর গ্যাং এর অত্যাচারে অতিষ্ট স্থানীয়রা জানান, কয়েকদিন আগে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আরিফ, অলি, রায়হান ও অন্তরদের সহযোগীদের সাথে নগরীর ইসলামপাড়া এলাকার কিশোর গ্যাং এর সাথে বিরোধ দেখা দেয়। তখন ইসলামপাড়া এলাকার গ্রুপ কে প্রচুর মারধর করে এরা এবং এক কিশোরের হাত কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। তাকে প্রথমে শের ই বাংলা হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হলেও পরবর্তীতে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেয়া হয়।
এদিকে মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন: মেডিকেল ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা যতটা না অবাধে চলাচল করে এসব কিশোর অপরাধীরা তার থেকেও অবাধে চলাচল করে। সন্ধ্যার পরে ছাত্রাবাস গুলোর পেছনে ও পুকুর পাড়ে বড় বড় গাছগুলোর নীচে মাদকের আখড়া বসায় এসব কিশোর গ্যাং এর সদস্যরা।
এতে করে ছাত্রদের লেখাপড়া করতে যেমন সমস্যা হচ্ছে তেমনি হরহামেশাই চুরি হচ্ছে মোবাইল সহ দামি জিনিস পত্র।
বিভিন্ন সময় সাধারণ ছাত্ররা এদের প্রতিবাদ করতে গেলে তারাও নানা ধরনের হেনস্থার শিকার হয়। এতে করে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে ডাক্তার, ছাত্র-ছাত্রী, হাসপাতালে ভর্তি রোগী ও তাদের স্বজনরা। এই গ্রুপের মূল হোতা সহ বাকী সদস্যদেরও আইনের আওতায় আনা উচিত বলে মনে করেন ডাক্তারী পড়তে আসা এসব ছাত্র-ছাত্রীরা। বিশেষ করে এই এলাকার মাদক ব্যাবসা বন্ধ করতে তারা বিশেষভাবে অনুরোধ জানান।
বিশ্বস্ত সূত্র গুলো বলছে, বরিশাল নগরীর বেলসপার্ক, মুক্তিযোদ্ধা পার্ক, ত্রিশ গোডাউন, মেডিকেল ক্যাম্পাস, চৌমাথা লেকপাড়, পলাশপুর, বৌবাজার, দপ্তরখানা, বিসিক, কাটপট্টি, কাউনিয়া, কাশিপুর এলাকাজুড়ে এসব কিশোর অপরাধীদের অবাধ আনাগোনা। এসব এলাকায় প্রশাসনের নজরদারি বাড়ালে কমবে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড।