ঘোড়াঘাট ছিল ৫০ বাজার ও ৫৩ গলির শহর। ঐতিহাসিক বুকান ও কানিংহামের মতে, মধ্যযুগের ঘোড়াঘাট ছিল ১০ মাইল লম্বা ও ২ মাইল চওড়া। শহরটি ছিল অত্যন্ত জনবহুল ও বসতিপূর্ণ শহর। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার সরকারি ওয়েবসাইটে বলা হয়, উপজেলার দক্ষিণ সীমানায় ঘোড়াঘাট ইউনিয়নের সাহেবগঞ্জ মৌজায় ঘোড়াঘাট দুর্গের অবস্থান। দুর্গের পূর্বধার ঘেঁষেই প্রবাহিত করতোয়া নদী এবং পশ্চিম, দক্ষিণ ও উত্তর দিকে (লাগোয়া) পরিখা দ্বারা বেষ্টিত। সুলতানী আমলের আগে এ দুর্গের ভিত প্রতিষ্ঠিত হলেও মোগল আমলে এসে এ চরম উন্নতি সাধিত হয়। উত্তরবঙ্গের মধ্যে এটি একটি মাঝারি ধরনের মাটির দুর্গ ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় অনেক গবেষকের গ্রন্থে।
কানিংহামের বরাতে আরো বলা হয়, ঘোড়াঘাট শহরের আয়তন ছিল উত্তর-দক্ষিণে ১০ মাইল ও প্রস্থে ২ মাইল। আ কা মো. যাকারিয়া সাহেবের বাংলাদেশ প্রত্নসম্পদ গ্রন্থের তথ্য মতে আলোচ্য দুর্গটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা ও পূর্ব-পশ্চিম দেয়ালের দৈর্ঘ্য অনুরূপ, উত্তর দেয়াল আধা মাইল এবং দক্ষিণ দেয়াল প্রায় এক মাইল লম্বা। ধারণা করা হয়, এ সীমানা শুধু দুর্গের কেন্দ্রের। বিশেষ করে দক্ষিণ দিকে আরো প্রলম্বিত ছিল। উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম ধারে যে পরিখা দেখা যায় তা প্রায় ৬০ ফুট চওড়া। পশ্চিম দেয়ালের উত্তরাংশে দুর্গের প্রধান প্রবেশ পথ ছিল। প্রধান প্রবেশ পথ থেকে ৪০০ গজ দক্ষিণ-পূর্ব দিকে দুর্গের দ্বিতীয় আন্তঃদেয়ালের গুরু। এর পাশেই ছিল ফৌজদার ভবন। তাছাড়া দুর্গবেষ্টনীর প্রধান অংশে ছিল প্রশাসনিক ভবন, সেনাছাউনি, সামরিক কর্মচারীদের বাসভবন, মসজিদ ও মাদরাসা। এখন শুধু পরিখার ওপর ৮/১০ ফুট উঁচু লালমাটির প্রাচীর আছে, যেগুলো পথিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মাটির প্রাচীরের ওপরে এখন আগাছা জন্মেছে। সম্রাট আকবরের আমলে এ দুর্গে ৯০০ আশ্বারোহী, ৫০টি হাতি ও ৩২,৬০০ পদাতিক সেনার স্থান সংকুলান হতো। দুর্গের অভ্যন্তর ভাগে পশ্চিম দিকে (পাকা সড়কের ধারে) ফৌজদার ভবনের কাছাকাছি জায়গায় একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদ, মসজিদের পশ্চিম ধারে পুরোনো জরাজীর্ণ কবর ও মসজিদের সামনে একটি ৮ কোণী ইদারা এবং দক্ষিণ পাশে লাগোয়া গোলাকার আর একটি পরিত্যক্ত ইদারা দৃষ্টিগোচর হয়। অধুনা স্থানটি মাজারপাড়া বলে পরিচিত। জঙ্গলে ঢাকা এ স্থানটি ২০০৭ সালে পরিষ্কার করা হয়।
১৭৫৬ সালে ইংরেজ সেনাপতি কট্রিল কর্তৃক ঘোড়াঘাটের শেষ মুসলমান ফৌজদার মীর করম আলী খান পরাজিত ও বিতাড়িত হন। পরে কোম্পানির সেনাদের মধ্যে অসংখ্য যুদ্ধ হয় এ ঘোড়াঘাটে। এরপরও ১৭৮৬ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশের আমল পর্যন্ত ঘোড়াঘাট জেলা ছিল। কিন্তু ১৭৮৭ সালে জেলার সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে ২৩টি জেলা করা হয়। সে কারণে ঘোড়াঘাট নামক এ জেলার বিলুপ্তি ঘটে। ফলে প্রশাসনিক দায়িত্ব দিনাজপুরে চলে গেলে স্থানীয়রাও অনেকেই এ স্থান ত্যাগ করে দিনাজপুরে যেতে শুরু করেন। এভাবে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায় ঘোড়াঘাট দুর্গ। দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট পৌরসভার ১নং ওয়ার্ড সাহেবগঞ্জ মৌজায় ঘোড়াঘাট দুর্গের অবস্থান। দুর্গটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা।
অধুনা স্থানটি ‘মাজারপাড়া’ বলে স্থানীয়দের কাছে পরিচিত। ধ্বংসপ্রাপ্ত দুর্গেও এ মসজিদ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হওয়া সত্ত্বেও দেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কোনো সাইনবোর্ড সেখানে দেওয়া হয়নি। উল্লেখ্য, এ স্থান থেকে ১ কিলোমিটার পূর্ব দিকে করতোয়া নদীর ধারে চম্পাতলীতে বাঁধানো ঘাট ও উঁচু একটি ঢিবি এখানো দৃষ্টিগোচর হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা এ স্থানকে পুঁথি সাহিত্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গাজী কালু ও চম্পাবতীর স্মৃতি বিজড়িত নিদর্শন বলে মনে করেন। দুর্গের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে আলাউদ্দিন হোসেন শাহর আমলে নির্মিত দ্বিতীয় আরো ১টি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ চাম্পাতলী থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। ওই মসজিদের শিলালিপিটি বগুড়া জাদুঘরে রক্ষিত আছে বলে বাংলাদেশ প্রত্নসম্পদ গ্রন্থে উল্লেখ আছে। বুকানন হেমিল্টনের দেওয়া তথ্যমতে, আলোচ্য মসজিদটি নবাব আলীবর্দী খাঁর আমলে ১১৫৩ হিজরিতে (১৭৪০ খ্রি.) মোহাম্মদ সালেহের ছেলে ও মোহাম্মদ হোসেনের ছেলে জয়নাল আবেদীন মসজিদটি নির্মাণ করেন। তিনিই এ ঘোড়াঘাট দুর্গের ফৌজদার ছিলেন।
মসজিদের সামনে ৮ কোণী (প্রায় ১২ ফুট বেড়) একটি পাকা ইদারা আছে। আবার একই মসজিদের দক্ষিণ ধারে লাগোয়া আর একটি ইদারা আছে। এর ওপরের মুখ এখন সমতল ভূমির সমান। মুখের ব্যাস প্রায় ৬ ফুট। ধারণা করা হয়, এ ইদারা দুটির পানি নামাজিদের অজুর জন্য ব্যবহার হতো। বর্তমানে পরিত্যক্ত, ভেতরে পানি নেই প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। ওপরে বর্ণিত দ্বিতীয় ইদারার পশ্চিম পাশে পাকা সড়কের ধারে মসজিদের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে লাগানো একটি পাকা কবরের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। বাঁধানো কবরের কিছু অংশের ইট খুলে পড়েছে। কবরটি কার তা জানা যায় না। এ কবরের আশপাশে আরো কিছু কবরের অস্তিত্ব বিদ্যমান। তবে সেগুলো মাটির সঙ্গে মিশে গেছে অনেক আগেই। ঘোড়াঘাট দুর্গের যে পুকুরে রাজারা গোসল করত, সেটি বর্তমানে স্থানীয়দের কেউ দখলমূলে ভোগদখল করে আসছে। ঘোড়াঘাট দুর্গ বিলীন হয়ে গেলেও দুর্গের এ মসজিদ ধ্বংসপ্রায়, যা বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত বিভাগের তালিকাভুক্ত হলেও কারো কোনো খোঁজ নেই। ইতিহাসের পাতায় আসনকৃত ঘোড়াঘাট দুর্গের শেষ চিহ্ন সাহেবগঞ্জ মৌজায় দুর্গ মসজিদ বা ভাঙা মসজিদটি বিলীন হতে চলেছে।
অন্যদিকে দুর্গের সংরক্ষিত ২৩.৩০ একর জমি কাগজে থাকলেও বাস্তবে নেই। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঘোড়াঘাট দুর্গের শেষ চিহ্ন দুর্গ মসজিদটি বিলীনের পথে যেতে না যেতেই কিছু ভূমি দখলকারীরা মসজিদের পূর্ব দিকে বাউন্ডারি ওয়াল এবং পশ্চিমে সীমানা পিলার দিয়ে ঘিরে নিয়েছে। তারা অপেক্ষায় রয়েছেন কখন শেষ চিহ্নটুকু মাটির সঙ্গে মিশে যায়। তখনই মুছে যাবে ঘোড়াঘাট দুর্গের শেষ স্মৃতি। এ বিষয়ে পৌরসভার ১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর রাহাত আহমেদসহ স্থানীয়রা প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ঘোড়াঘাট দুর্গের শেষ চিহ্ন এ ভাঙা মসজিদটি যেহেতু সরকারি সম্পদ এবং এ মসজিদকে ঘিরে যে ঐতিহাসিক গল্প আমরা ছোটবেলা থেকে বাপদাদার মুখে শুনে এসেছি, এর স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখতে চাই।