জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ, বন উজাড়, অতিমাত্রায় প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ ও নগরের অতি পরিকল্পনার ফলে বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্য দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ ঘোষিত “বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস” প্রতিবছর ২২ মে পালিত হয়, যার মূল উদ্দেশ্য সার্বিকভাবে জীববৈচিত্র্য রক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরা এবং বৈশ্বিক সচেতনতা সৃষ্টি করা। ২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য “Be Part of the Plan” অর্থাৎ “পরিকল্পনার অংশ হোন” আমাদের প্রত্যেককে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের অভিযানে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানায়।
বিশ্বের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব অপরিসীম। জীবনের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি প্রাণী ও উদ্ভিদের উপস্থিতি পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রকে কার্যকর রাখে। অথচ এই বহুবর্ণিল প্রাণপ্রবাহ আজ চরম হুমকির মুখে। প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে বাংলাদেশ এক অনন্য অবস্থানে রয়েছে। দেশের দক্ষিণে বিস্তৃত সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, পাহাড়ি চট্টগ্রাম অঞ্চলের উঁচু নিচু টিলা, উত্তর-পূর্বের হাওর-বাঁওড়, অসংখ্য নদ-নদী ও বনজ পরিবেশ, এসব মিলিয়ে গড়ে উঠেছে এক বৈচিত্র্যময় বাস্তুতন্ত্র। এ দেশে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ, গাঙ্গেয় ডলফিন, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, কীট-পতঙ্গ, ঔষধি উদ্ভিদ, জলজ প্রাণীসহ অসংখ্য জীব ও উদ্ভিদের আবাসস্থল রয়েছে। তবে আশঙ্কার বিষয় হলো, এই প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য আজ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে। বনাঞ্চলের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে, জলাশয় ভরাট হয়ে যাচ্ছে, কৃষিজমিতে অপ্রয়োজনীয় রাসায়নিক ব্যবহার বেড়েছে, অতি নোৱৰায়ণ, রাস্তা নির্মাণ ও কৃষিজমির ব্যবহার পরিবর্তন করে কারখানা বা তথাকথিত পরিকল্পিত আবাসন, এই সকল মানব সৃষ্ট কর্মকান্ডের চাপে প্রাকৃতিক পরিবেশ হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। একাধিক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, বাংলাদেশে গত ৫০ বছরে বহু প্রজাতির স্থানীয় উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে বা বিলুপ্তির পথে।
জীববৈচিত্র্য রক্ষা এখন আর শুধু পরিবেশবাবিদ, পরিবেশবাদী, পরিবেশ সেচ্ছাসেবক, বা গবেষকদের আলোচনার বিষয় নয়, বরং এটি বৈশ্বিক টেকসই উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (Sustainable Development Goals – SDGs) এর অন্তত ৭টি লক্ষ্যমাত্রা সরাসরি জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে রয়েছে ভূমির ব্যবহার, পানির সংস্থান, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও কল্যাণ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমন এবং সমুদ্রসম্পদ ব্যবস্থাপনা। ২০২২ সালে কানাডার মন্ট্রিয়লে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক COP15 সম্মেলনে গৃহীত “Kunming-Montreal Global Biodiversity Framework” জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক আন্দোলনে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
এই বৈশ্বিক কাঠামোর অধীনে জাতিসংঘ ২০৩০ সালের মধ্যে জীববৈচিত্র্যের অবক্ষয় রোধ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ পুনরুদ্ধারের জন্য চারটি মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এগুলো হলো- বিশ্বের অন্তত ৩০% ভূমি ও জলভাগ সংরক্ষিত অঞ্চলে পরিণত করা (30 by 30 goal), প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করা, বিপন্ন প্রজাতি বিলুপ্তির গতি থামানো, এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন ও প্রযুক্তি স্থানান্তরকে সহজতর করা। এই লক্ষ্যমাত্রাগুলো পূরণে সরকার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, নাগরিক সমাজ, স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও আদিবাসীদের পারস্পরিক সহযোগিতামূলক অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য “Be Part of the Plan” বা “পরিকল্পনার অংশ হোন” এই বৈশ্বিক কাঠামোরই একটি জনপ্রিয়ীকরণমূলক রূপ, যার উদ্দেশ্য হলো-সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারক, শিক্ষার্থী, কৃষক, উদ্যোক্তা, স্থানীয় সরকার,সকল স্তরের মানুষকে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা পালনের জন্য উদ্বুদ্ধ করা। পৃথিবীর যেসব অঞ্চল জলবায়ু সংকট ও পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন, সেখানে এই ধরনের সচেতনতা কর্মসূচির গুরুত্ব আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। বিশেষত গ্লোবাল সাউথ বা দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলো,যেমন বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কঙ্গো, ব্রাজিল প্রভৃতি,যারা বিপুল জীববৈচিত্র্যের ধারক, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বাধিক ঝুঁকির মুখে, তাদের জন্য এই আন্তর্জাতিক কাঠামো বাস্তবায়ন একটি চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনার দ্বৈত বার্তা বয়ে আনে। বর্তমানে পৃথিবীর ১০ লাখেরও বেশি প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন। ইউএনইপি, আইইউসিএন, ডাব্লিউডব্লিউএফ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মতে, যদি অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয়, তবে এই শতাব্দীর মধ্যভাগেই জীববৈচিত্র্যের এক বিরাট অংশ চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে। অথচ জীববৈচিত্র্য কেবল প্রাণিকুল বা উদ্ভিদের অস্তিত্বের জন্য নয়, বরং মানবজাতির খাদ্য, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, ওষুধ, এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সাথেও গভীরভাবে সম্পৃক্ত।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন জীববৈচিত্র্য-ভিত্তিক অভিযোজন (Ecosystem-based Adaptation) ও প্রকৃতিনির্ভর সমাধান (Nature-based Solutions) নীতি হিসেবে গৃহীত হচ্ছে। নরওয়ে, কোস্টারিকা, কেনিয়া, ভুটান, এবং চিলির মতো দেশগুলো ইতোমধ্যেই জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সফল মডেল তৈরি করেছে। এই মডেলগুলো কেবল পরিবেশ রক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পর্যটন, স্থানীয় জীবিকা, ও সামাজিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রেও ইতিবাচক ফল দিচ্ছে। ২০২৫ সালের বার্তা তাই শুধুই প্রতীকী নয়, বরং এটি এক বাস্তব ও জরুরি আহ্বান,যেখানে প্রতিটি দেশ, প্রতিটি অঞ্চল ও প্রতিটি মানুষকে নিজেদের পরিকল্পনা, উন্নয়ন এবং দৈনন্দিন সিদ্ধান্তের সঙ্গে জীববৈচিত্র্যের রক্ষাকল্পে চিন্তা করতে হবে। এটি কোনো একক সংগঠনের কাজ নয়, বরং এটি বৈশ্বিক সংহতির নিদর্শন,যেখানে মানুষ ও প্রকৃতির সহাবস্থানই ভবিষ্যতের পথে চালক শক্তি হয়ে উঠবে।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কাজ কখনোই একক কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দ্বারা সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এটি একটি সম্মিলিত সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক দায়িত্ব, যার কেন্দ্রে রয়েছে নাগরিক ও রাষ্ট্র, উভয়ের স্বতঃস্ফূর্ত ও কার্যকর অংশগ্রহণ। পৃথিবীর প্রতিটি জীবের অস্তিত্ব নির্ভর করে একটি সুসংহত বাস্তুতন্ত্রের ওপর, আর এই বাস্তুতন্ত্র রক্ষার মূল চাবিকাঠি মানবজাতির হাতে। ফলে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নাগরিক সচেতনতা ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলতা পরস্পর নির্ভরশীল। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আমাদের রয়েছে নানামুখী করণীয়। প্রতিদিনের ছোট ছোট সিদ্ধান্ত, যেমন- প্লাস্টিকের পরিবর্তে পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী ব্যবহার, রাসায়নিকের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহারে উৎসাহ, জীবজন্তুর আবাসস্থানে হস্তক্ষেপ না করা, স্থানীয় গাছপালা সংরক্ষণ, পাহাড়-জঙ্গল-জলাশয় ইত্যাদি প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়াতে গিয়ে পরিচ্ছন্নতা রক্ষা, কিংবা জীববৈচিত্র্য বিষয়ক সামাজিক সচেতনতা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, এসবই বৃহৎ পরিসরে পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। শহরাঞ্চলের মানুষ যান্ত্রিক জীবনে আবদ্ধ থাকলেও তাদের রয়েছে বিকল্প সুযোগ- ছাদে বা বারান্দায় গাছ লাগানো, শহরের সবুজ বেষ্টনী সংরক্ষণে নাগরিক আন্দোলনে যুক্ত হওয়া, প্রাকৃতিক খাদ্য বাছাই করা, কিংবা জলবায়ু সচেতন ভোক্তা হিসেবে দায়িত্বশীল জীবনযাপন। গ্রামীণ জনগণ, যারা প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত, তারা পারিবারিক বন, হাওর-বাঁওড় ও চরাঞ্চলে স্থানীয় প্রজাতি সংরক্ষণ এবং ঐতিহ্যভিত্তিক টেকসই কৃষিচর্চার মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য রক্ষার এক নিরব, কিন্তু মহৎ ভূমিকা পালন করতে পারে।
অন্যদিকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব কেবল আইন প্রণয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সেই আইন বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দক্ষ প্রশাসন এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাও জরুরি। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপর অর্পণ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি, অবাধে বনভূমি উজাড়, পাহাড় কাটা, নদী দখল, শিল্প-কারখানার বর্জ্য ফেলা কিংবা অপ্রতিরোধ্য নগর সম্প্রসারণের ফলে দেশের মূল্যবান জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই দরকার কঠোর নজরদারি, পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যকর শক্তিশালীকরণ, স্থানীয় সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বিত ভূমিকা এবং আদালতের নির্দেশনাসমূহ বাস্তবায়নে দৃঢ়তা।
রাষ্ট্র যদি আন্তরিকভাবে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এগিয়ে আসে, তাহলে এর সুফল বহুমাত্রিকভাবে ফিরে আসবে। যেমন- জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় প্রাকৃতিক প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি, কৃষিতে উৎপাদনশীলতা ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত, পর্যটন খাতে প্রবৃদ্ধি এবং জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়তা। একইসঙ্গে আমাদের দরকার একটি বিজ্ঞানভিত্তিক জাতীয় জীববৈচিত্র্য নীতি, যেখানে গবেষণা, স্থানীয় জ্ঞান এবং আন্তঃমন্ত্রণালয় সহযোগিতা থাকবে একসূত্রে বাঁধা। জীবন ও প্রকৃতির পারস্পরিক নির্ভরতার কথা বিবেচনায় নিয়ে ‘জীববৈচিত্র্য বাজেট’ চালু করা, জীববৈচিত্র্যভিত্তিক শিক্ষা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা, এবং প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করা- এসব হতে পারে রাষ্ট্রের কার্যকর পদক্ষেপ। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও আদিবাসীদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা। তাদের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর ঐতিহ্যগত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা রাষ্ট্রকে সহায়তা করতে পারে একটি অধিক অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায্য জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে। উদাহরণস্বরূপ, পার্বত্য চট্টগ্রামে জুমচাষ ও বন ব্যবস্থাপনায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর টেকসই জ্ঞান, বা সুন্দরবনের মাওয়ালী ও বাওয়ালীদের অভিজ্ঞতা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য অমূল্য সম্পদ।
সর্বোপরি, রাষ্ট্র যদি পরিবেশবিদদের সাথে নিয়ে পরিবেশবান্ধব নগরায়ণ, সবুজ অবকাঠামো উন্নয়ন এবং ক্লাইমেট স্মার্ট কৃষিনীতির মাধ্যমে জীববৈচিত্র্যের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হয়, তবে বাংলাদেশের মতো জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ একটি দেশ ভবিষ্যতের জন্য একটি উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে।