মহিপালে ৭ জনকে হত্যাসহ ২২ মামলার রাঘববোয়াল আসামিরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে, হতাশায় শহীদদের পরিবার,
গত বছরের ভয়াল ৪ আগস্টে ফেনীর মহিপালে ছাত্র-জনতার একদফা দাবির গণআন্দোলনের সময় পুলিশের উপস্থিতিতে সংঘটিত হয় দেশের ইতিহাসের অন্যতম নির্মম গণহত্যা। উড়ালসেতুর নিচে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমাবেশে হামলা চালিয়ে পিটিয়ে, কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয় ৭ ছাত্র-জনতাকে। আহত হন আরও দেড় শতাধিক।
নিহতরা হলেন: ফুলগাজীর ইশতিয়াক আহম্মেদ শ্রাবণ, দাগনভূঞার সারওয়ার জাহান মাসুদ, সোনাগাজীর মাহবুবুল হাসান মাসুম, জাকির হোসেন শাকিব, ফেনী সদরের সাইদুল ইসলাম, ওয়াকিল আহম্মেদ শিহাব এবং পৌর এলাকার মোহাম্মদ সবুজ।
রণক্ষেত্রে পরিণত মহিপাল, হাসপাতালজুড়ে বিভীষিকা
ঘটনার দিন বেলা সাড়ে ১১টা থেকে হঠাৎ মহিপাল এলাকায় গুলির শব্দে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়। মুহূর্তেই এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আহত ও নিহতদের নেওয়া হয় ফেনী জেনারেল হাসপাতালে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দেখা যায় বিভীষিকাময় দৃশ্য।
সিনিয়র নার্স মো. তরিকুজ্জামান বলেন, এত গুলিবিদ্ধ ও মৃতদেহ একসাথে আসতে আমরা অভ্যস্ত না। পা ফেলার জায়গা ছিল না, শুধু রক্ত আর আর্তনাদ।
মেডিকেল অফিসার ডা. নাজমুল হক সাম্মি জানান, “সব রোগী ছিল ক্রিটিক্যাল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়। হাসপাতালের সব বিভাগ একত্রিত হয়ে চিকিৎসা দেয়।”
২২ মামলা, ৬১৯৯ আসামি, অধরাই মূল অভিযুক্তরা
ফেনী জেলা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, এই ঘটনায় মোট ২২টি মামলা হয়—এর মধ্যে ৭টি হত্যা মামলা ও ১৫টি হত্যাচেষ্টা মামলা। মোট আসামি ৬১৯৯ জন, যার মধ্যে ২১৯৯ জনের নাম রয়েছে এজাহারে।
বড় বড় অভিযুক্তদের তালিকায় রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ তিন আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সাবেক চেয়ারম্যান, মেয়র ও আওয়ামী লীগের নেতারা। তবে অভিযোগ রয়েছে এই রাঘববোয়ালদের কেউ কেউ দেশ ছেড়েছেন, বাকিরা থেকে গেলেও গ্রেপ্তার হয়নি।
শহীদ পরিবারের কান্না: “আমরা বিচার চাই”
নিহত ইশতিয়াক আহম্মেদ শ্রাবণের পিতা নেছার আহম্মদ বলেন, “আমরা টাকা চাই না, অট্টালিকা চাই না। শুধু সন্তান হত্যার বিচার চাই।”
তার মা ফাতেমা আক্তার শিউলি বলেন, “৪ আগস্টের পর থেকে আমরা বেঁচে আছি, কিন্তু জীবন থেমে গেছে। বিচারের আশায় পথ চেয়ে আছি।”
আইনি অগ্রগতি: ছোট মাছ ধরা হলেও বড়রা ধরাছোঁয়ার বাইরে
আইনজীবী মেজবা উদ্দিন ভুঞা বলেন, “সিসিটিভি ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী হামলাকারীরা ছিল ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থক। কিন্তু এখনও রাঘববোয়ালদের একজনকেও আইনের আওতায় আনা হয়নি।”
পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমান বলেন, “এ পর্যন্ত এক হাজারের বেশি আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১১ জন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। একটি মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।”
ফেনীর ভয়াল ৪ আগস্ট কেবল একটি দিন নয়—এটি ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ ও রাষ্ট্রীয় বর্বরতার এক নির্মম দলিল। বিচারহীনতা শুধু শহীদ পরিবারদের নয়, বরং সমগ্র জাতির উপর একটি স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন। একবছর পেরিয়ে গেলেও যেহেতু রাঘববোয়ালরা অধরাই, তাই প্রশ্ন থেকে যায়—বাংলাদেশ কি সত্যিই আইনের শাসনের পথে এগোচ্ছে?