নাটোরের লোলেশন রেলস্টেশন। দিনের বেলায় এই প্ল্যাটফর্ম দিয়ে হাঁটে শত শত যাত্রী, ট্রেন আসে যায় নিয়মিত, কিন্তু রাত নামলেই বদলে যায় চিত্র। স্টেশনের খোলা প্ল্যাটফর্মটাই হয়ে ওঠে শত হতভাগ্য মানুষের একমাত্র আশ্রয়।
কেউ দিনমজুর, কেউ ভবঘুরে, কেউবা মানসিক রোগী—নেই কোনো ঠিকানা, নেই খাবারের নিশ্চয়তা, নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই। রাত হলেই তাঁরা ছুটে আসেন স্টেশনের সিমেন্টের মেঝেতে, রেললাইনের পাশেই বিছিয়ে ফেলেন তাঁদের সামান্য চাদর বা পুরনো বস্তা। কারো মাথার নিচে ভাঙা বালিশ, কেউ মাথা রাখেন ব্যাগে বা হাড়ভাঙা কাঁধে। আর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাঁরা রাত পাড়ি দেন জীবনের এক অন্ধকার অধ্যায়ে।
স্টেশনের বাতির আলোয় আলোড়িত হয় তাঁদের নিঃসঙ্গতা। চারপাশে ব্যস্ততা থেমে গেলেও থামে না তাঁদের জীবনের কষ্ট। কেউ একমুঠো খাবারের আশায় ঘুরে বেড়ায় দিনভর, কেউ রোগে-শোকে কাতর—তবুও পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই। না আছে সরকারী কোনো তদারকি, না আছে সমাজের কোন সহযোগিতা।
একজন বয়স্ক মানুষ জানালেন,
“আমার কোনো ঘর নাই। দিনমজুরির কাজ পাই না। রাতে এইখানে ঘুমাই, সকালে আবার রাস্তায় নামি।”
রেলস্টেশনটির কর্তৃপক্ষও বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হলেও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বা মানবিক সহায়তা প্রদানের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। অথচ এই মানুষগুলোও এই দেশের নাগরিক, তাঁদেরও আছে বাঁচার অধিকার, সম্মানের অধিকার।
সাধারণ যাত্রীদের মাঝে অনেকে তাদের দেখে সহানুভূতি প্রকাশ করলেও, দিনের শেষে তাঁরা সবাই নিঃসঙ্গ। এই দৃশ্য শুধু নাটোর নয়—বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি রেলস্টেশনেই একই করুণ বাস্তবতা।
প্রয়োজন এখন একটি সমন্বিত উদ্যোগ—
যাতে স্থানীয় প্রশাসন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও সচেতন নাগরিকরা এগিয়ে আসেন। প্রয়োজন তাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়, খাবার, চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা।
রেলস্টেশনের এই নীরব মানুষগুলোর গল্প যেন না হারিয়ে যায় শহরের কোলাহলে। তাদের প্রতি একটু মানবিক হাত বাড়িয়ে দিলে হয়তো বদলে যেতে পারে অনেক অন্ধকার রাত।