বিশাল মাঠজুড়ে চারিদিকে ইটের স্তুপ। কোথাও কোথাও কাঁদা পানি, আবার কোথাও পোঁতা হয়েছে বাঁশের খুঁটি। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে এটি কোন ইটভাটার অফ সিজন অথবা যুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকার চিত্র। তবে তা নয়, এটি ছয় দশকের অধিক পুরোনো চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার প্রধান স্টেডিয়াম। দেড় মাসব্যাপী মেলার আয়োজন করার পর স্টেডিয়ামের মাঠ খুঁড়ে এভাবেই ফেলে রাখা হয়েছে। মেলা শেষ হওয়ার এক মাস এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও খেলাধুলার উপযোগী করার কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
জানা যায়, চেম্বার অব কমার্সের উদ্যোগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ স্টেডিয়ামের মাঠ খুঁড়ে আয়োজন করা হয় শিল্প ও বাণিজ্য মেলার। কিন্তু মেলা শেষ হওয়ার এক মাস এক সপ্তাহের অধিক সময় পেরিয়ে গেলেও করা হয়নি সংস্কার। ফলে এখনও মাঠের মধেই পড়ে আছে ইটের স্তুপ, বাঁশ, কাঠ, পাথর।
সরেজমিনে দেখা যায়, দীর্ঘদিন মেলা ও পরবর্তীতে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকায় স্টেডিয়ামের মাঠের মধ্যেই জন্ম নিয়েছে গাছপালার। এছাড়াও জঙ্গল তৈরি হয়েছে মাঠের ঘাসে। ক্রিকেটের পিচের উপরে জন্ম হয়েছে গাছের, ফুটবলের মাঝমাঠে জমে আছে পানি। এমন অবস্থায় প্রায় ৩ মাসের অধিক সময় ধরে স্টেডিয়ামে হচ্ছে না বিভিন্ন বয়স ভিত্তিক খেলোয়াড়দের দৈনিক অনুশীলন ও খেলাধুলা। মাঠের চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইটের ছোট ছোট টুকরো ও পাথর। মাঠজুড়ে রয়েছে খানাখন্দ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ স্টেডিয়ামে প্রায় এক বছর ধরে অনুশীলন করে জেলার ফকির পাড়া এলাকার শুভ। তিনি বলেন, আমরা স্টেডিয়ামের অনেক পরিচর্যা করতাম। নিয়মিত পানি দেয়া, ঘাস কাটার মতো কাজ আমরা নিজেরা ও কোচরা করতেন৷ কিন্তু গত তিন মাস আগে হঠাৎ করে স্টেডিয়ামের মধ্যে মেলার আয়োজন করা হলে সকল খেলাধুলা ও অনুশীলন বন্ধ হয়ে যায়। আমরা এখন সেখানে আর যেতে পারি না। অনেক কষ্ট করে প্রধান স্টেডিয়াম বাদ দিয়ে কয়েক কিলোমিটার দূরে শহরের বাইরের মাঠে প্র্যাকটিস করছি।
সাবেক ফুটবলার মো নাসিরুল ইসলাম শুভ জানায়, আমরা এখন জেলা স্টেডিয়ামের দিকে যেতেই পারি না। কারন মাঠের যে অবস্থা, তা দেখে সহ্য করতে পারি না। মাঠকে খুড়ে বাঁশের খুঁটি পুতে রাখা হয়েছে এখনো। মাঠের মধ্যেই পানি-কাদা ও ছোট ইটের টুকরো ও পাথর পড়ে আছে। অথচ কথা ছিল মেলা শেষ হওয়ার পরপরই মাঠ সংস্কার করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু মেলা শেষ হওয়ার ৫ সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কোচ বলেন, এসব নিয়ে বলার ভাষা খুঁজে পাই না। মাঠের মধ্যে যেভাবে ইট ও বাঁশ পোঁতা হয়েছে, তা যেন আমাদের বুকের উপর করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন অনুমতি দিলে কারো কিছুই করার থাকে না। এই মাঠ ঠিক করে প্র্যাকটিস করলে ছেলেদের অনেক ইনজুরির শঙ্কা থাকে।
পঞ্চাশোর্ধ কলেজ শিক্ষক হাসান আলী বলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ার জায়গায় এমনভাবে মেলার আয়োজনে অবাক হয়েছে জেলাবাসী। শোনা যাচ্ছে, জেলা প্রশাসক নাকি ১৬ লাখ টাকা নিয়ে এই মেলার আয়োজনে অনুমতি দিয়েছেন। এই সিদ্ধান্তে জেলা প্রশাসন ও জেলা ক্রীড়া সংস্থা টাকা নিলেও হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে আগামীর খেলোয়াড়দেরকে। আমরা চাই, ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এ নিয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব মনিরুজ্জামান মনির বলেন, মেলার শুরুর আগে চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ও মেলা কমিটি ঘোষণা দিয়েছিল, মেলা শেষ হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু এক মাস এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও সংস্কারের কোন উদ্যোগ না নেয়া অত্যন্ত দুঃখজনক।
স্থানীয় উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত ও ঐতিহ্যবাহী পন্যকে তুলে ধরার কথা বলে অনুমতি নিলেও মেলায় ছিল নিম্নমানের ও বিদেশে পন্যের সমাহার। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা ক্রীড়া সংস্থার এক সদস্য বলেন, মেলা শুরুর আগে একরকম স্লোগান দিয়ে শুরু হয়েছিল। কিন্তু শুরুর পর দেখা যায়, সব বিদেশি পণ্যের সমাহার ছিল তথাকথিত শিল্প ও বাণিজ্য মেলায়৷ এমনকি স্থানীয় উদ্যোক্তাদেরও দেয়া হয়নি স্টল। দেড় শতাধিক স্টলের মধ্যে শুধুমাত্র একটিই স্থানীয় স্টল ছিল, সেটিও আবার এক নারী মহিলা লীগ নেত্রীকে দেয়া হয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, জেলার কয়েকশ স্থানীয় উদ্যোক্তা থাকলেও শুধুমাত্র স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল জেলা মহিলা লীগের কোষাধ্যক্ষ এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি আব্দুল ওদুদর ঘনিষ্ঠ নারী নেত্রী রাজিয়া সুলতানা সম্পাকে। মেলার স্টলে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন করে কেক কাটে। এনিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হলে পুলিশ ২৪ জুন রাতে তাকে আটক করে। পুরো মেলাটিই ছিল বির্তকে ভরা। জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে এ নিয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
এ বিষয়ে দফায় দফায় যোগাযোগের চেষ্টা করলেও বক্তব্য দিতে রাজি হননি জেলা প্রশাসক ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার আহ্বায়ক মো. আব্দুস সামাদ। একাধিকবার ফোন দিলেও রিসিভ করেননি তিনি। এমনকি হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ দিলেও রিপ্লাই দেননি।
মেলার আয়োজক কমিটি ও চেম্বার অব কমার্সের দাবি, শীগ্রই সংস্কার করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে স্টেডিয়ামকে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহ-সভাপতি এবং শিল্প ও বাণিজ্য মেলা কমিটির আহ্বায়ক খাইরুল ইসলাম মুঠোফোনে জানান, আবহাওয়াজনিত কারনে ঠিকভাবে সংস্কার কাজ করা যায়নি। আশা করি, খুব কম সময়ের মধ্যে সংস্কারকাজ সম্পন্ন করে আগের অবস্থায় স্টেডিয়ামকে ফিরিয়ে দেয়া হবে।
প্রসঙ্গত, প্রায় দেড় মাসব্যাপী মেলায় দেড় শতাধিক স্টল ছিল। ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ স্টেডিয়ামে প্রতিদিন শতাধিক ক্রিকেট, ফুটবলের বয়স ভিক্তিক খেলোয়াড়রা অনুশীলন করেন।