৮ জুলাই ২০২৪ বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ এবং আবেগঘন দিন। এই দিনে দেশের সর্বস্তরের শিক্ষার্থী রাজপথে নেমে আসে চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থার সংস্কার এবং মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত করার দাবিতে রাজপথ জুড়ে তখন ছিল শুধু এক স্লোগান—”কোটা নয়, মেধার মূল্যায়ন চাই!”এই দিনটি শুধু একটি আন্দোলনের দিন নয়, বরং এটি ছিল ছাত্রদের আত্মসম্মান, ভবিষ্যৎ ও ন্যায়ের জন্য রুখে দাঁড়ানোর এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত।বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থা চালু ছিল। এর ফলে অনেক সময় মেধাবী শিক্ষার্থীরা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকরিতে সুযোগ পেত না। এই প্রেক্ষাপটে কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্রসমাজ একত্রিত হয়ে কয়েক বছর আগেও আন্দোলনে নামে।কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ব্যবস্থার অসঙ্গতি আরও প্রকট হয়ে ওঠে। ২০২৪ সালে প্রকাশিত বিসিএস প্রিলিমিনারি ও নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে মেধাবী ছাত্রদের বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ উঠলে আন্দোলন আবারও জোরালো হয়।সকাল থেকেই ঢাকার শাহবাগ, টিএসসি, নীলক্ষেত, প্রেসক্লাব, মিরপুরসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে শিক্ষার্থীদের জটলা দেখা যায়। ঢাবি, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, কলেজের ছাত্রছাত্রীরা এই বিক্ষোভে অংশ নেয়।রাস্তায়-রাস্তায় ছিল পোস্টার-প্ল্যাকার্ড, স্লোগান আর চোখে আগুন জ্বলা প্রতিবাদ।১. কোটা বাতিল বা যৌক্তিক সংস্কার২. চাকরিতে শতভাগ মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করা৩. বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুযায়ী সাম্য ও ন্যায়ের সমাজ গঠন৪. আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ।দুপুর নাগাদ আন্দোলন আরও বিস্তৃত রূপ নেয়।অনেক জায়গায় পুলিশ শিক্ষার্থীদের রাস্তা থেকে সরাতে লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস ছোড়ে।অনেক শিক্ষার্থী আহত হয়, কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়।ঢাবি টিএসসি, কার্জন হল, শাহবাগে শিক্ষার্থীদের স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ।সন্ধ্যার পরও রাজপথ ছিল ছাত্রছাত্রীদের দখলে। একজন শিক্ষার্থীর কথায় –“আমরা ঘুমাই না, খাই না, পড়ি সারাদিন, বিসিএস-এর জন্য জীবন উৎসর্গ করি। অথচ শেষমেষ দেখা যায় — একজন মেধাবীকে বাদ দিয়ে কোটা সুবিধাপ্রাপ্ত কেউ চলে যাচ্ছে। এই তো সমাজের বিচার?”এই ক্ষোভ, অভিমান আর অসহায়ত্ব থেকেই জন্ম নেয় ৮ জুলাইয়ের অভূতপূর্ব প্রতিবাদ।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে #JusticeForMerit, #QuotaReform, #মেধার_বিচার ট্রেন্ডিং শুরু হয়।দেশের বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক ও সচেতন নাগরিকরাও এই আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন।সরকার পক্ষ থেকে প্রথমে নিশ্চুপ থাকলেও পরে আলোচনার আশ্বাস আসে। ৮ জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলন একটি বার্তা দিয়েছিল—শুধু চাকরি নয়, তারা চেয়েছে ন্যায্যতা,তারা চেয়েছে সম্মান ও মেধার প্রকৃত মূল্যায়ন,তারা প্রমাণ করেছে, ছাত্ররাই জাতির বিবেক।৮ জুলাই ২০২৪ ছিল ছাত্রদের জাগরণের দিন। এই দিন প্রমাণ করে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস ছাত্রসমাজের মধ্যে এখনও আছে। তারা শুধুমাত্র নিজের চাকরির জন্য নয়, সমাজের ন্যায়ের পক্ষে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও আওয়াজ তুলেছে। এই দিনটি ইতিহাসে লেখা থাকবে—
“যেদিন ছাত্ররা বলেছিল — কোটা নয়, মেধার জয় চাই”।