রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ও আন্তঃবিভাগীয় যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক খেলায় সংঘর্ষ যেন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি বছরগুলোতে দেখা যায়, খেলায় প্রত্যাশিত ফলাফল না হওয়ায় খেলোয়াড়দের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী প্রক্টর, শিক্ষক ও আম্পায়ারদের আহত ও লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ফলে সঠিক ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও মানসিক বিকাশে কার্যকরী ভুমিকা পালনকারী এ খেলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে এখন আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে।এদিকে, সর্বশেষ সোমবার (১৮ নভেম্বর) বিকাল ৫টায় বিশ্ববিদ্যালয় স্টেডিয়ামে আন্তঃবিভাগ ফুটবল টুর্নামেন্ট-২০২৪ এর রাউন্ড-১৬ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং ও আইন বিভাগের মধ্যকার খেলায় স্লেজিংকে কেন্দ্র করে দুই দফায় ইট-পাটকেল ছোড়াছুড়ি হয় এবং লাঠিসোঁটা নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। ফলে, ক্যাম্পাসের এমন অরাজক পরিস্থিতিতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে অভিভাবকরাও।সর্বশেষ সংঘর্ষের ঘটনায়, মার্কেটিং বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. নুরুজ্জামানের গাড়িতে ভাংচুর, আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মাহফুজুর রহমানসহ দুই বিভাগের অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হন। এছাড়াও পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে বণিক বার্তার রাবি প্রতিনিধি আবু সালেহ শোয়েবের উপর চড়াও হোন বিক্ষুব্ধ মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এ সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে টুর্নামেন্টের আয়োজন কমিটির ব্যর্থতা ফুটে উঠেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকেও রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ সহায়তায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।এছাড়াও এবছর ১২ ফেব্রুয়ারি আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট প্রতিযোগিতা-২০২৪ এর ফাইনালখেলার দ্বিতীয় ইনিংসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বনাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলায় ক্যাচ ধরাকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। সেসময় শিক্ষার্থীদের কাছে অসহায় হয়ে উভয় দলকে যৌথ বিজয়ী ঘোষণা করে রাবি প্রশাসন।গত বছরের ২২ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ কামাল স্টেডিয়ামে আয়োজিত আন্তঃবিভাগীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্টের ফাইনাল ম্যাচে আম্পায়ারকে পেটানোর অভিযোগ উঠে গণিত বিভাগের শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে।তাছাড়াও গতবছর ২৬ আগস্ট সন্ধায় আন্তঃবিভাগ বাস্কেটবল প্রতিযোগিতা ২০২৩-এর ফাইনালে উপাচার্যের সামনেই তুমুল সংঘর্ষে লিপ্ত হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা। দুপক্ষের চেয়ার ছুড়াছুঁড়িতে পন্ড হয়ে যায় ফাইনাল ম্যাচটি।
খেলায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই সংঘর্ষের পর ক্যাম্পাসে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিষয়টিকে নেতিবাচকভাবেই দেখছেন। তারা মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কাছে সামান্য একটি খেলাকে ঘিরে এমন উত্তেজনা-সংঘর্ষ এবং ইট-পাটকেল ছুড়াছুঁড়ি কোনোভাবেই কাম্য নয়।খেলাধুলার মারামারি ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরবি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলা হলো একটা নির্মল ও সুন্দর বিনোদন এবং পরস্পর সম্প্রীতির বন্ধন। অথচ গত কয়েক বছর ধরে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন।দোষী বিভাগকে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী কয়েক ম্যাচ নিষিদ্ধ করা এবং শরীর চর্চা বিভাগের পক্ষ থেকে রেফারিদের বিষয়ে আরো মনোযোগী হওয়া দরকার জানিয়ে তিনি আরো বলেন, একজন দক্ষ অথচ উশৃঙ্খল খেলোয়াড়ের চেয়ে একজন ভদ্র বিনয়ী খেলোয়াড়ই উত্তম।বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুর্শিদা ফেরদৌস বিনতে হাবীব বলেন, ‘খেলায় তো উত্তেজনা থাকেই। কিন্তু আমরা সেটাকে বেশি পার্সোনালাইজ করে ফেলছি। শিক্ষার্থীরা হার মেনে নিতে পারছেনা; মানে হারাটাও যে খেলার একটা অংশ সেটা শিক্ষার্থীরা বুঝতে চেষ্টা করে না।এটা স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারলে কোন ঝামেলা সৃষ্টি হতো না। বিগত ঝামেলার মূল কারণটা হলো পরস্পর সহিষ্ণুতার অভাব।মনোবিজ্ঞান বিভাগের এই অধ্যাপক আরও বলেন, ”শিক্ষার্থীদের সামাজিক মূল্যবোধ, বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া ও সত্যকে স্বীকার করে নেওয়ার ঘাটতি আছে। যার ফলে আমরা বিগত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সাক্ষী হয়েছি। শিক্ষার্থীদের মানসিক পরিবর্তন ছোটবেলা থেকেই পরিবার বা স্কুল থেকেই হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় পক্ষ শিক্ষার্থীদের মানসিক উন্নতির জন্য সেমিনারের আয়োজন করা যেতে পারে। আমরা যদি সবকিছুকে পজিটিভলি নিতে পারি তাহলে কোনো ঝামেলা সৃষ্টি হবে না।এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, দিনের পর দিন যখন কোনো নিয়মকানুন ছাড়া চলতে থাকে একসময় সেটা সহিংসতায় চলে যায় এবং নিজেদের মধ্যে স্বৈরাচারী আচরণ চলে আসে। যারা আমরা খেলা দেখতে আসি তাদেরও নৈতিকতা অনেক ঘাড়তি আছে। খেলার মাঠে দর্শকরা অনেকে স্লেজিং নামে যে বাক্য ব্যবহার করে সেগুলো এত অশ্রাব্য যা শ্রুতিকটু।খেলায় যেকোনো বিশৃঙ্খলা এড়াতে প্রক্টর বলেন, “এখন থেকে যেকোনো খেলায় প্রক্টরিয়াল বডি এবং বিভাগের ২ জন শিক্ষক উপস্থিত থাকবে। বিভাগের শিক্ষকরা উপস্থিত না থাকলে শিক্ষার্থীদের খেলায় অংশগ্রহণ করতে দেয়া হবে না এবং দর্শকদের স্টেডিয়ামে নিদিষ্ট ২টা দরজা থাকবে আলাদাভাবে গ্যালারিতে প্রবেশ করবে।সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব জানান,বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলা নিয়ে সংঘর্ষের যে ঘটনা ঘটেছে সেটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক। যারা পরিবেশে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে এবং ভাঙচুর ও সহিংসতার চেষ্টা চালিয়েছে তাদেরকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসবো।খেলার পরিবেশ ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য আমরা কাজ করছি।