বাংলাদেশ সরকার ২০২৫ থেকে ২০৫৫ সাল পর্যন্ত একটি দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় স্থানিক পরিকল্পনা (National Spatial Plan – NSP) প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ToR তৈরির কাজ করছে বলে শুনা যাচ্ছে। পরিকল্পনাটি দেশের স্থল, জল, আকাশ এবং ভূগর্ভস্থ অঞ্চলের টেকসই ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ সংরক্ষণ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা ইত্যাদির একটি রূপরেখা তৈরি করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করা হচ্ছে।
পরিকল্পনার কাঠামোতে পরিবেশ, অর্থনীতি, কৃষি, প্রযুক্তি, নগরায়ন, গ্রামীণ উন্নয়ন, ব্লু ইকোনমি, জ্বালানি ও পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতকে একত্রে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন রয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের এটি নিঃসন্দেহে একটি সময়োপযোগী ও সাহসী পদক্ষেপ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে।
তবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভাবার সুযোগ রয়েছে। জনগণের চাহিদা যেহেতু দ্রুত বদলায়; তাই পরিকল্পনার সংশোধনের জন্য খুব বেশিদিন অপেক্ষা না করিয়ে, পরিকল্পনা পুনর্মূল্যায়নের জন্য ৩ থেকে ৫ বছর অর্থাৎ একটি নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ কালের মধ্যে যেন পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ থাকে সেই ব্যাপারে ভালোভাবে খেয়াল রাখতে হবে। তা নাহলে গণতান্ত্রিক কাঠামোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবেনা এই পরিকল্পনা। সেই সাথে, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক পদ্ধতির প্রস্তাবনা থাকা প্রয়োজন এই পরিকল্পনায়।
এছাড়া, এটি একটি জাতীয় পরিকল্পনা হওয়ায় সার্বজনীন অংশীজনদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেই তৈরি হওয়া প্রয়োজন। পরিবেশ, কৃষি, অর্থনীতি, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা—প্রতিটি খাতে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের অংশগ্রহণ এবং তাদের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিলে পরিকল্পনা আরও গ্রহণযোগ্য ও কার্যকর হতে পারে। যেমন, ভূমি ব্যবহার সংক্রান্ত বিষয়গুলো ড্যাপ-সহ বিভিন্ন পরিকল্পনা দলিলে যা দেখা যায়, তা সব ধরনের ভূমির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না-ও হতে পারে। কিছু ভূমিকে সংরক্ষিত ঘোষণা করে পরিবর্তন নিষিদ্ধ করাই হতে পারে টেকসই পরিকল্পনার একটি অংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন নয়, খাদ্য উৎপাদন, পরিবেশ সংরক্ষণ, পানি উন্নয়ন, যোগাযোগ, স্বাস্থখাত, ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই জোর দেয়া উচিৎ, যদি কোনো পরিকল্পনার মাদ্ধমে কেউ সত্যি সত্যি দেশের ভালো চায়।
জাতীয় স্থানিক পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বাস্তবায়ন কাঠামো। পরিকল্পনাটি সফল করতে হলে একটি শক্তিশালী মনিটরিং ও সমন্বয় সেল গঠন জরুরি, যেখানে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, পেশাজীবী সংস্থা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার এবং সিভিল সোসাইটির সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকবে। এছাড়া, রাজনৈতিক অস্থিরতা, নীতির ধারাবাহিকতার অভাব, এবং স্থানীয় পর্যায়ে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা নিশ্চিত না হলে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন জটিল হয়ে উঠতে পারে। যেমন, কৃষিজমি হারানো, বনভূমি উজাড়, নদী ও প্লাবনভূমিতে অনিয়ন্ত্রিত প্রকল্প গ্রহণ, ইত্যাদি NSP-এর পরিবেশগত লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। NSP বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশন, নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর, RAJUK, BWDB, LGED, পরিবেশ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়, পেশাজীবী সংস্থা, গবেষণা সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়, এনজিও এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের সমন্বিত অংশগ্রহণ প্রয়োজন। প্রত্যেককে নিজ নিজ ভূমিকায় যুক্ত করে একটি স্টেকহোল্ডার ম্যাপ তৈরি করা যেতে পারে, যাতে পরিকল্পনা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়।
সবশেষে বলা যায়, NSP বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিতে পারে। তবে তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো, সবার অংশগ্রহণ, এবং পরিবেশ ও সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল একটি দৃষ্টিভঙ্গি। সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে এটি দেশের স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের পথে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে।