খাগড়াছড়ির ভাইবোনছড়ায় সেটলার বাঙালি কর্তৃক এক কিশোরী স্কুল ছাত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, তার প্রতিবাদে আয়োজিত ছাত্র বিক্ষোভে সেনাবাহিনীর হামলা, চট্টগ্রামে কারা হেফাজতে ভান লাল রোয়াল বমের মৃত্যুর (হত্যা) প্রতিবাদে এবং আটককৃত নিরাপরাধ বমদের মুক্তির দাবিতে ঢাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম।
আজ বিকাল ৪ টায় ঢাকা শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এই বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশে গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সভাপতি জিকো ত্রিপুরা সভাপতিত্বে ও পিসিপির সাধারণ সম্পাদক শুভাশীষ চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন, ইউনাইডেট ওয়ার্কার্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক প্রমোদ জ্যোতি চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি অমল ত্রিপুরা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সদস্য রূপসী চাকমা। এতে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি সদস্য ও অধিকার কর্মী মারজিয়া প্রভা ও বম স্টুডেন্টস এসোসিয়েশনের সভাপতি লাল রিথাং বম।
পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিস্থিতি তুলে ধরে অমল ত্রিপুরা বলেন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পতনের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়িরা একটা আশার বুক বেঁধেছিল যে, অন্ততপক্ষে পাহাড়ের পরিস্থিতি কিছুটা হলেও পরিবর্তন ঘটবে, পাহাড়ে সেনাশাসনের অবসান হবে, পাহাড়িরা নিজেদের প্রথাগত ভুমি অধিকার ফিরে পাবে, জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি মিলবে। কিন্তু আমরা তার বিপরীতে দেখতে পাচ্ছি। পাহাড়ে প্রতিনিয়ত সেনাবহিনী অভিযান চলছে, সেনা-প্রশাসন কর্তৃক সাজেকে কলেজ নির্মাণ বাধা দেয়া হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটেছে। ভুমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে এবং ধর্ষণ-ধর্ষণের পর হত্যার মত ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। রাষ্ট্রীয় মদদে বম জাতিসত্তার নারী-শিশু-পুরুষদের বছরে পর বছর বিনা বিচারে কারাগারে আটক রেখে একে একে হত্যা করা হচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত তিন জন বম নাগরিকের কারাগারে মত্যু হয়েছে।
খাগড়াছড়ি গণধর্ষণের ঘটনা রাষ্ট্রীয় জাতিগত নিপীড়নের অংশ উল্লেখ করে অমল ত্রিপুরা বলেন, খাগড়াছড়ি ভাইবোনছড়ায় স্কুলছাত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনা নতুন নয়, এটা রাষ্ট্রের জাতিগত নিপীড়নের অংশ। এর আগেও বান্দরবানে খেয়াং নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিল, মহালছড়িতে বাড়িতে ঢুকে কোলে থাকা শিশুকে কেড়ে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছিল। এর আগেও এ ধরনের ঘটনার শিকার হওয়া তুমাচিং-সবিতা, ভারতী, কৃত্তিকা ত্রিপুরাসহ অসংখ্য নামের তালিকা রয়েছে, এসব কোন ঘটনারই বিচার হয়নি। আর সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনা হচ্ছে, সহপাঠী গণধর্ষণের বিচার চাইতে গিযে গতকাল শত শত শিক্ষার্থীর শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে সেনাবাহিনী অতর্কিতে হামলার ঘটনা। সেখানে সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়া ডিবিসি নিউজের সাংবাদিক মিলন ত্রিপুরাসহ অন্তত দু’জনকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে। আমরা সেনাবাহিনীর এহেন কর্মকাণ্ডকে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।
সমাবেশে অমল ত্রিপুরা বলেন, গত বছরে আজকের এই দিনে সারাদেশে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভরত অবস্থায় ছিল, কারো লাশ পড়েছে, কেউ হামলার শিকার হয়েছে, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার মত ঘটনাও ঘটেছিল। এক বছর আগে এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করেছিল পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকার। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটেছে এবং শেখ হাসিনাকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও পতিত হাসিনার মত দেশ শাসন করছে উল্লেখ করে অমল ত্রিপুরা বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পরে আমরা দেখছি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও শেখ হাসিনার মত দেশকে পরিচালনা করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোন স্থিতিশীলতা নেই, কোথাও কোথাও রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে নাগরিকদের ওপর নিপীড়ন চালানো হচ্ছে, হত্যা করা হচ্ছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থী।
তিনি, দেশের প্রকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ন্যায়ের পক্ষে অবিচল থেকে পাহাড়-সমতরে সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শাসকগোষ্ঠীর সকল ধরনের অন্যায় নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
সমাবেশে জিকো ত্রিপুরা বলেন, পাহাড়ে সেনাবাহিনী যদি নিরপেক্ষ থাকতো তাহলে গণধর্ষণে জড়িত সকলে অচিরেই গ্রেফতার হতো। তারা পালানোর সুযোগ পেত না। তিনি ঘটনায় জড়িত সকল অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতার করা না হলে জনগণকে সাথে নিয়ে আন্দোলনের হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
প্রমোদ জ্যোতি চাকমা বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমালে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করেছিলেন, জেলে গিয়েছিলেন, কথা বলেছিলেন তাদের মধ্যে কয়েকজন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে থাকলেও তারা বম জাতিসত্তার নারী-পুরুষদের মুক্তির বিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন না।
মারজিয়া প্রভা বলেন, ২৯ বছরেও কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচার হয়নি। ইতিমধ্যে কল্পনা অপহরণের মামলা আদালত খারিজ করে দেয়া হয়েছে। চিহ্নিত অপরাধী লে. ফেরদৌস গংরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেরাচ্ছে। কল্পনা অপহরণ দিবসে কাউখালীতে সমাবেশে অংশগ্রহণ করে ফেরার পথে আমাদের ওপর সেটলার ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা হামলা করেছিল।
তিনি আরো বলেন, দেশে প্রগতিশীল চিন্তার মনষ্ক, যারা অধিকারের বিষয়ে সংবেদনশীল, পাহাড়ে জাতিগোষ্ঠীরা যখন পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের কথা বলেন তখন তাদের মধ্যে বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠের চেতনা চলে আসে। তিনি জুলাই স্প্রিটকে ধরে রাখার জন্য বৈষম্য বিরোধী সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করার আহ্বান জানান।
রূপসী চাকমা বলেন, পাহাড়ে ধর্ষণ-গণধর্ষণ হত্যার যেসব ঘটনা ঘটছে তার কোন ঘটনারই বিচার হচ্ছে না। যার ফলে এসব ঘটনা পুনরাবৃত্তি ঘটছে। তিনি নারীর সম্ভ্রম ও নিরাপত্তা রক্ষার্থে সকলকে লড়াইয়ে সামিল হওয়ার আহ্বান জানান।
লাল রিথাং বম বলেন, বাংলাদেশে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আমরা বৈষম্যর বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। কিন্তু সে বৈষম্য এখনো দূর হয়নি। সমতলে এক ও পাহাড়ে এক শাসন চলছে। পাহাড়ে আজ পর্যন্ত যেসব গণহত্যা-খুন-ধর্ষণ-অধিকার হরণ করা হয়েছে কোনটিরই বিচার হয়নি। অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ে আমাদেরকে ভয়ে আতঙ্কে বাড়িতে চলাফেরা করতে হয়। জায়গায় জায়গায় বসানো চেকপোস্টে তল্লাশির শিকার হতে হয়।
তিনি আরো বলেন, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণের কথা বলে লড়াই করলেও সবই বিফল হয়ে গেছে। এদেশে বড় বড় অপরাধীরা, জঙ্গিরা জেল থেকে ছাড়া পাচ্ছে, কিন্তু কারাগারে বম জাতির নারী-শিশু, পুরুষ, শিক্ষার্থীদের মুক্তি দেওয়া হচ্ছে না। ‘কুকি চিন’ দমনের নামে গণহারে গ্রেফতার করে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। কারাগারে বন্দি থাকা বমরা যদি অপরাধী হয় তাহলে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্য বিচার করা হোক, শাস্তি দেয় হোক। কিন্তু নিরাপরধ বমদের এভাবে জেলে রাখবেন না, তাদেরকে মুক্তি দিতে হবে।
সমাবেশ থেকে বক্তরা, পার্বত্য চট্টগ্রাম সেনাশাসন প্রত্যাহারপূর্বক পতিত সরকারে আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য জারীকৃত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ১১ দফা নির্দেশনা বাতিল, পাহাড়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত, কারাগারে নিরপরাধ বম জাতির নারী-শিশু, শিক্ষার্থী, পুরুষদের মুক্তিসহ অবিলম্বে গতকাল ভাইবোনছড়ায় শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে হামলাকারী সেনাসদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ও ভাইনোনছড়ায় স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনার বিচারের দাবি জানান।
সমাবেশে সংহতি জানিয়ে উপস্থিত ছিলেন বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক জাবির আহম্মেদ জুবেল, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফ, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের অর্থ সম্পাদক স্কায়া ইসলাম ও বম স্টুডেন্ট কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক রুবেন বম।
সমাবেশে পরে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি শাহবাগ থেকে শুরু করে রাজুভাস্কর্য প্রদক্ষিণ করে টিএসসি গেইটের সামনে গিয়ে শেষ হয়।