বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার মতো নেত্রকোনায়ও সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে স্বাস্থ্যসেবার নামে চলছে রমরমা বাণিজ্য। এতে সাধারণ রোগীরা চরম হয়রানি ও আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। ঈদ কিংবা ছুটির দিনে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে তথাকথিত ‘বিশেষজ্ঞ ডাক্তার’ এনে রোগীদের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা এবং একটি শক্তিশালী দালাল চক্রের অপতৎপরতা পুরো স্বাস্থ্য খাতকে একরকম ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। এতে একদিকে যেমন রোগীরা সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনি আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকে। প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রতারণা নেত্রকোনার বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো এখন লাভজনক ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্যই হলো যেকোনো উপায়ে রোগীর পকেট খালি করা। অভিযোগ রয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগেরই অংশীদার খোদ চিকিৎসকরা। তারা রোগীদের অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে কমিশন বাবদ অর্থ উপার্জন করেন। প্রায়শই দেখা যায়, রোগ নির্ণয়ের নামে অসংখ্য অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা দেওয়া হয়, যার ফলে রোগীর চিকিৎসা খরচ কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এই অনৈতিক কর্মকাণ্ডের পেছনে একটি সংঘবদ্ধ দালাল চক্র কাজ করে, যারা হাসপাতালগুলোর জন্য রোগী সংগ্রহ করে এবং তাদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে। বিশেষ করে দরিদ্র এবং অসচেতন রোগীরা এই ফাঁদের মূল শিকার হন। স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকারি নির্ধারিত ফির কোনো তোয়াক্কা না করে ইচ্ছামতো ভিজিট ও পরীক্ষার ফি আদায় করা হয়। একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের ভিজিট ৪০০-৫০০ টাকা হওয়া উচিত হলেও, দালাল ও সিরিয়ালের নামে তা ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। ফলে রোগীরা প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করানোর পর ওষুধ কেনার সামর্থ্যও হারিয়ে ফেলেন। এর বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালালেও অপরাধীরা এতে ভীত নয়। তারা মনে করে, অর্থের বিনিময়ে সহজেই এসব ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
সরকারি হাসপাতালের করুণ দশা ও অব্যবস্থাপনা একদিকে যখন বেসরকারি খাতে চলছে রমরমা বাণিজ্য, তখন সরকারি হাসপাতালগুলোর অবস্থাও শোচনীয়। সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করে আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম কিনলেও সেগুলোর সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। অনেক দামি মেশিন অব্যবহার ও অযত্নের কারণে নষ্ট হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, কিছু কর্মচারী এবং অসাধু কর্মকর্তা ইচ্ছাকৃতভাবে এসব যন্ত্র অকেজো করে রাখে, যাতে রোগীরা বাধ্য হয়ে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যায়। এর মাধ্যমে তারা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হন। অথচ মাত্র ১০ টাকার টিকেট কেটে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিলে সাধারণ মানুষ অনেকটাই উপকৃত হতে পারে। সরকারি হাসপাতালে রোগীরা ঠিকমতো ওষুধও পান না; বাইরে থেকে কিনতে হয়। এটি রোগীদের ভোগান্তি আরও বাড়ায়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা নামমাত্র ডিউটি করেন। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত তাদের পাওয়া গেলেও এরপর তাদের আর হাসপাতালে দেখা যায় না। যেখানে অন্যান্য সরকারি চাকরিজীবীদের চাকরির সময়সীমা সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা, সেখানে ডাক্তাররা শুধু হাজিরা দিয়ে বাইরের ক্লিনিক বা হাসপাতালগুলোতে অর্থ উপার্জনের নেশায় বিভোর হয়ে ওঠেন। এতে করে সরকারি হাসপাতাল শুধু বেতন-ভাতা নেওয়ার একটি মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই রোগীদের প্রকৃত সেবা নিশ্চিত করতে ডাক্তারদেরও অন্যান্য অফিসের মতোই সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ডিউটি করা ও হাসপাতালে থাকা জরুরি। অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি হাসপাতালের সামনে একটি শক্তিশালী অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে, যা সাধারণ রোগীদের জন্য আরও বড় ভোগান্তির কারণ। সরকারি অ্যাম্বুলেন্স গুলো প্রায়শই অকেজো অবস্থায় পড়ে থাকে, ফলে রোগীরা বাধ্য হয়ে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের শরণাপন্ন হন। এই বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সগুলো রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে। আরও গুরুতর অভিযোগ হলো, বাইরের কোনো অ্যাম্বুলেন্স রোগী নিয়ে এলে তাদের কাছ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা আদায় করা হয়, অন্যথায় তারা ফিরে যাওয়ার অনুমতি পায় না। হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে এই সিন্ডিকেট প্রকাশ্যেই চাঁদাবাজি চালাচ্ছে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে রোগী আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রেও একই ধরনের ‘সেলামি’ বাবদ অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে, যা সাধারণ মানুষের আর্থিক চাপ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রয়োজন কঠোর প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ নেত্রকোনার স্বাস্থ্য খাতে চলমান এই নৈরাজ্য বন্ধে অবিলম্বে কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত এই বিষয়ে দ্রুত নজর দেওয়া। চিকিৎসার ভিজিট এবং পরীক্ষার ফি সরকারিভাবে নির্ধারণ করে তা কঠোরভাবে কার্যকর করা, দালাল চক্রের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা এবং সরকারি হাসপাতালের অব্যবহৃত সরঞ্জামগুলো সচল করার ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। পাশাপাশি, অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের চাঁদাবাজি বন্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সক্রিয় হতে হবে। মানবিক মূল্যবোধের অভাব এবং শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের নেশা থেকে বেরিয়ে এসে স্বাস্থ্যসেবাকে সত্যিকার অর্থে জনগণের সেবায় রূপান্তরিত করা সম্ভব, যদি সরকার ও প্রশাসন এই বিষয়ে কঠোর হয়। জনগণ প্রত্যাশা করে, এই নীরব চাঁদাবাজি ও প্রতারণার হাত থেকে তারা রেহাই পাবে এবং সুস্থ ও নিরাপদ চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার ফিরে পাবে।