আমপানের দাপটে নদীবাঁধ ভেঙে বানভাসি হয়েছে খেত, পুকুর আর বসতবাড়ি। প্রাথমিক হিসেব অনুযায়ী, অন্তত ৮৭ কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। বার বার কেন এই দুর্গতি? পরিবেশ নিয়ে এত রকম কথাবার্তা বলি আমরা, কিন্তু আমাদের নিজেদের ঘরের কাছে পরিবেশ বাঁচানোর ব্যবস্থাটুকু করে উঠতে পারি না?
সুন্দরবনের ৩৫০০ কিলোমিটার নদীবাঁধ দেখভাল করার দায়িত্ব মূলত রাজ্যের সেচ দফতরের। একশো দিনের কাজের প্রকল্পের মাধ্যমেও বাঁধ সংরক্ষণ করা হচ্ছে বছর দশেক। তবু বাঁধ ছাপিয়ে নোনাজল উপচানোর ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। প্রায়ই বাঁধ ধসে পড়ে প্লাবিত হয়েছে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। ২০১০-২০১৬-র মধ্যে সুন্দরবনে জলস্ফীতির কারণে ৯৫টি প্লাবন হয়েছে, অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে অন্তত দশ বার। এক দশক আগে এই মে মাসেই আয়লার প্রকোপে ছিন্নভিন্ন সুন্দরবনে এমনই রব উঠেছিল। বিপর্যস্ত বাসিন্দারা অনেকেই বলছেন আয়লা প্রকল্পে বাঁধ পুনর্গঠন যদি ঠিক ভাবে হলে আমপানের আঘাতে হয়তো এতটা ক্ষতি হত না। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, নদীবাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে যদি কোনও প্রতিবন্ধকতা থাকে, তা হলে তা কাটিয়ে ওঠা যাচ্ছে না কেন ?
একটা কারণ সরকারের দীর্ঘসূত্রিতা। বরাদ্দ টাকা খরচ করতে বছর ঘুরে যায়, সাধারণ বাঁধ মেরামতির টেন্ডার ডাকতে ডাকতে বর্ষা উপস্থিত হয়, যখন বাঁধের কাজ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আয়লা বাঁধ পুনর্গঠন প্রকল্পে বরাদ্দ হয়েছিল পাঁচ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বাঁধ পুনর্গঠনের জন্যে জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া বাধা পেয়েছে। অডিট রিপোর্টে (সিএজি, ২০১৬) দেখি, জমি অধিগ্রহণ ও বাঁধ পুনর্গঠনের লক্ষ্যমাত্রা সরকার পূরণ করেছে মাত্র ১৬ শতাংশ এবং ১ শতাংশ। এর একটা কারণ জমির ক্ষতিপূরণ পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা, ফলে জমি দিতে অনীহা। বাঁধের জন্যে জমি নেওয়া শুরু হয় ২০১১ সালে, অথচ পুনর্বাসন প্যাকেজ চালু হয় তিন বছর পরে।
আর একটি কারণ হল, সেচ দফতর এবং ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। সিএজি রিপোর্ট বলছে, যেখানে সেচ দফতরের প্রকল্প অনুমোদন ও রূপায়ণের জন্যে সর্বোচ্চ ১০৫ দিন ধার্য করা আছে, সেখানে ভূমি দফতর এই কাজ করতে সময় নিয়েছে ২৩৪ থেকে ১৭৪৩ দিন। হিঙ্গলগঞ্জের সমশেরনগর এবং কুলতলির বৈকুণ্ঠপুরের মতো অঞ্চলে আয়লা প্রকল্পে সরকারি বাঁধ নির্মাণ হয় শুরুই হয়নি, নইলে শুরু হয়েও বাঁধের কাঠামো আধাখেঁচড়া অবস্থায় রয়ে গিয়েছে। এগুলি এ বারেও ক্ষতিগ্রস্ত।
খামতি শুধু সরকারের নয়। সুন্দরবনের একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষ বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন নিজেদের জমি হাতবদলের ফলে। জমি যখন নিজের, তা যতই ছোট হোক, মানুষ সেই জমি রক্ষা করার জন্য বাঁধের দিকে নজর দেবেন। জমি অন্যের হাতে চলে গেলে সে তাগিদ কমে যাবে। চাষ যত অলাভজনক হচ্ছে, ততই চাষের জমি বদলে যাচ্ছে মাছের ভেড়িতে বা ইটভাটায়।
সুন্দরবনের বহু অঞ্চলে, যেমন সন্দেশখালি বা বাসন্তীতে, ভেড়ি ব্যবসায়ীরা বাঁধ কেটে দেন। জোয়ারের সময় মাছের মীন বয়ে নোনাজল ভেড়িতে ঢুকে আসে। ভেড়ির জমিগুলি অধিকাংশই মৌখিক চুক্তিতে ঠিকা নেওয়া হয়। মুখের কথাতেই অঙ্গীকার থাকে যে ভেড়ি মালিকরা নিজস্ব খরচে জমির নিকটবর্তী বাঁধ দেখাশোনা করবেন। কাজের বেলা তাঁরা তা করেন না। তাঁদের বাধ্য করার উপায়ও নেই। অন্য দিকে, সেচ দফতরের বাস্তুকারদের একাধিক বার বলতে শুনেছি ভেড়ি অঞ্চলের বাঁধ তাঁরা সারাবেন না, কারণ ভেড়ি মালিকরা মাটি কেটে বাঁধের কাঠামো দুর্বল করে তুলছেন। আয়লার সময়ে যে সব জায়গায় বাঁধ ভেঙে প্লাবন হয়েছিল, তার একটা বড় অংশ ছিল ভেড়ি অঞ্চলে। আমপানের সময়েও এই একই ছবি উঠে এসেছে।
সম্প্রতি ভেড়ি ব্যবসার তুলনায় ইটভাটার সংখ্যা বাড়ছে। তাদের বিরুদ্ধেও বাঁধের মাটি কাটা, বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণ করার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার অভিযোগ উঠেছে। ইটভাটার মালিকরা কেন বাঁধে বিনিয়োগ করেন না? তার অনেক কারণ থাকতে পারে। হতে পারে তাঁরা আমপানের মতো বড় বিপর্যয় যে ঘটতে পারে, এই সম্ভাবনাকে আমল দেননি। বাঁধ অবহেলার আর একটি বড় কারণ হল, এই ব্যবসার পুঁজি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আসে সুন্দরবনের বাইরে থেকে। এই ‘বহিরাগত’ পুঁজিপতিদের বাঁধ রক্ষার সামাজিক দায় থাকে না। নোনাজল ঢুকে ফসল নষ্ট হলে চাষি পথে বসে যায়, কিন্তু সম্পন্ন পুঁজিপতিরা এই ধাক্কা কিছু দিনের মধ্যে সামলে নিতে পারেন।
অর্থাৎ বাঁধ রক্ষার ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগের ঢিলেমির পাশাপাশি অনিয়ন্ত্রিত পুঁজির প্রবেশও বিপর্যয়ের একটি কারণ। সুন্দরবনে যে বেসরকারি পুঁজির বিনিয়োগ হচ্ছে, তার একটা অংশকে সরকারের মধ্যস্থতায় বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের কাজে না লাগালে ভবিষ্যতেও এই বিপর্যয় এড়ানো কঠিন হবে। যে সব অঞ্চলে বাঁধের লাগোয়া ভেড়ি বা ইটভাটা চালু হয়েছে, সরকার তাদের মালিকদের থেকে বাঁধ সুরক্ষা বাবদ কর সংগ্রহ করতে পারেন। করব্যবস্থা চালু হলে ভেড়ি বা ইটভাটাগুলি নিজেদের নথিভুক্ত করতে বাধ্য হবে, ফলে তাদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারের সুবিধে হবে।
যে বিনিয়োগ ব্যয়ের কোনও প্রতিদান পাওয়া যায় না, অর্থনীতির পরিভাষায় তাকে ‘সাঙ্ক কস্ট’ বলে। যে দ্বীপপুঞ্জ গত কয়েক দশক ধরে ধসে যাচ্ছে, তার বাঁধ পরিকাঠামোয় বিনিয়োগ করাটা অনেকেই এমন ‘জলে-যাওয়া খরচ’ বলে মনে করেন। যে কোটি কোটি টাকা খরচ করে এই ধরনের ঝুঁকিপ্রবণ এলাকায় বাঁধ নির্মাণ হচ্ছে, সেই অর্থ ব্যবহার করে কি এই এলাকার বাসিন্দাদের পুনর্বাসন করা যায় না? সুন্দরবনের বিপর্যয়প্রবণ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়া পরিবারের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। অর্থাৎ বাঁধ সংরক্ষণ বা বিপর্যয় প্রতিরোধ প্রকল্পে যে টাকা সরকার বিনিয়োগ করছে, তাতে আস্থা রাখতে না পেরে মানুষ ব্যক্তিগত খরচে বিকল্প স্থানে বসতি স্থাপন করছে। সুন্দরবনের যে অংশ নিয়ত সমুদ্র-গ্রাসে বিলীন, সেখানে বাঁধ সংরক্ষণ এবং পুনর্গঠনের সঙ্গে পুনর্বাসনের সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
এত দিন পর্যন্ত সুন্দরবনের বাঁধ সংরক্ষণে জোর দেওয়া হয়েছে প্রযুক্তিকেন্দ্রিক ব্যবস্থার ওপর, যার মূল লক্ষ্য ছিল বাঁধের কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে ভাঙন বা ক্ষয় রোধ করা। যেমন, আয়লা পরবর্তী সময়ে কথা হয়েছিল তৈরি করা হবে কংক্রিট বাঁধ, ব্যবহার করা হবে পলিপ্রপিলিনের আস্তরণ। কিন্তু প্রযুক্তির পাশাপাশি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উপাদানগুলিকে মান্যতা দেওয়া চাই।
সুন্দরবনের নদীবাঁধের সমস্যাটা আসলে বহুমাত্রিক। ভৌগোলিক অবস্থান যেমন নদীবাঁধকে বিপন্ন করে, তেমনই তার আশপাশের এলাকার মানুষের জীবিকার প্রয়োজনেও বাঁধের ক্ষতি হয়, বাঁধ উপেক্ষিত হয়। তাই নদীবাঁধ রক্ষার জন্য কোনও একটি নির্দিষ্ট নীতি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা কম। চাই এমন নীতি, যা প্রযুক্তির সঙ্গে আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলিকেও নজরে রাখবে।