১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইপিআর সদর দপ্তর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনসসহ কয়েকটি জায়গায় একযোগে হত্যাযজ্ঞ চালানোর পরদিন অর্থাৎ ২৬শে মার্চের ঢাকা ছিল স্তম্ভিত, শোকার্ত ও ভয়াল এক নগরী।
শহরে ছিলো কারফিউ কিন্তু তার মধ্যেই ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষজন অলিগলি পাড়ি দিয়ে শহর ছাড়তে শুরু করেছিল।
সেদিন ঢাকাতেই ছিলেন এমন কয়েকজন জানিয়েছে, শহরের যেকোনো জায়গা থেকেই আগুন আর ধোঁয়া থেকেই রাতের আক্রমণের তীব্রতা বোঝা যাচ্ছিলো।
“কারফিউ ছিল এবং শহরে কোন ধরনের পরিবহন ছিলো না, মানুষ স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলো। কারও সাথে দেখা হলেও মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিলো না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও লেখক আফসান চৌধুরী।
ঢাকার মগবাজারের দিলু রোডে মি. চৌধুরীদের বাসায় তখন আশ্রয় নিয়েছিলো অনেক মানুষ।
“দুপুরের মধ্যেই সবার জানা হয়ে গেছে পাকিস্তান বাহিনীর নৃশংসতার খবর। মানুষ শহর ছাড়তে শুরু করলো,” বলছিলেন তিনি।
পঁচিশে মার্চের রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী যে অভিযান চালিয়েছিলো তাতে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এবং এটি বাংলাদেশে ‘কালো রাত বা কালরাত্রি’ হিসেবেই পরিচিত।
দিনটিকে গণহত্যা দিবস হিসাবে পালনের একটি প্রস্তাব বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ২০০৭ সালে অনুমোদিত হয়।
এর আগে মার্চের শুরু থেকেই রাজনৈতিক উত্তেজনা তুঙ্গে ছিল।
সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ভাষণের পরই পরিস্থিতি পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে এবং তখনকার পূর্ব পাকিস্তান কার্যত চলতে থাকে শেখ মুজিবের নির্দেশে।
এরপর মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হলেও তার আড়ালেই ঢাকায় সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিতে থাকে পাকিস্তান সরকার। সে অভিযানেরই আনুষ্ঠানিক নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ শিরোনামের একটি বইয়ে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নিয়ে লিখেছেন।
এতে তিনি তিনি লিখেছেন যে সামরিক অভিযানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, ‘শেখ মুজিবের ডিফ্যাক্টো শাসনকে উৎখাত করা এবং সরকারের (পাকিস্তানের) কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।’
আর সেই অভিযানের নামে আসলে চালানো হয় গণহত্যা এবং গ্রেফতার করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে।
কিন্তু গ্রেফতারের আগেই অর্থাৎ ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের নয় মাস ব্যাপী স্বাধীনতার লড়াই।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক, গবেষক ও ঢাকায় থাকা মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, পঁচিশে মার্চের রাতের গণহত্যার জের ধরে ২৬শে মার্চের দিনের বেলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা ও রাজারবাগের পুলিশ লাইনস এলাকায় আগুনের কুণ্ডলী দেখা যাচ্ছিলো।
এর মধ্যেও পরিচিতদের খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করেছেন অনেকে। যদিও কারফিউ থাকায় বের হওয়ার সুযোগ ছিলো সীমিত।
তেজগাঁও এলাকায় রাইফেল হাতে পুলিশ সদস্যদের সাথে ব্যারিকেড তৈরি করেছিলেন এখনকার ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান এম এ হাসান।
“আমরা সেদিন তেজগাঁও এলাকায় অবস্থান নিয়েছিলাম। ইপিআরের তিন নম্বর গেটেও ভালো প্রতিরোধের খবর পাচ্ছিলাম। পিলখানা ও রাজারবাগে যে প্রতিরোধ রচনা করেছিলো পঁচিশে মার্চের রাতে, তা চলছিলো ছাব্বিশে মার্চের সকাল পর্যন্ত। যদিও শেষ পর্যন্ত আক্রমণের মুখে টিতে পারেনি ইপিআর ও পুলিশ”, বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন।
এমন পরিস্থিতিতে ছাব্বিশে মার্চের দুপুর থেকেই আসলে শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ দলে দলে পালাতে শুরু করে। দু’একটি এলাকায় টেলিফোন সচল থাকলেও অধিকাংশ এলাকায় তাও ছিলো না।
দুপুরের পর থেকে অনেকে পরিচিত বা স্বজনদের, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ও আশেপাশের এলাকায় যাদের স্বজনরা ছিলো, নানাভাবে তাদের খোঁজে বের হওয়ার চেষ্টা করেন।
মি. হাসান পরদিন সাতাশে মার্চে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখতে পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জ্যোতির্ময়গুহ ঠাকুরতাসহ অনেককে। পরে তিনি জগন্নাথ হল এলাকা থেকেও এক নিকটাত্মীয়কে উদ্ধার করে নিয়ে আসতে সক্ষম হন।
“পুরো এলাকা ছিলো ধ্বংসযজ্ঞের নমুনা। যেখানে সেখানে পড়ে ছিলো মৃতদেহ,” বলছিলেন তিনি।(সূত্র:বিবিসি বাংলা)