মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি, গণতন্ত্রের আপোষহীন সৈনিক, নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক, বঙ্গবীর জেনারেল মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানী আজীবন সংগ্রাম করেছেন মুক্তিকামী মানুষের জন্য, জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন দেশ ও জাতির জন্য। আজকের এই দিনে গভীর শ্রদ্ধার সহিত স্মরণ করছি তাকে।মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানী ১৯১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন বৃহত্তর সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ মহকুমায় জন্ম গ্রহণ করেন। ওসমানী সাহেব এর পৈতৃক নিবাস সিলেট জেলার ওসমানীনগর উপজেলার দয়ামীর গ্রামে।ইতিহাস থেকে জানা যায় ওসমানীর পূর্বপুরুষ ত্রয়োদশ শতাব্দীতে হযরত শাহজালালের (রহ.) সাথে ওই সময়ে আগত ৩৬০ জন আওলিয়ার অন্যতম আওলিয়া হযরত শাহ নিজাম উদ্দিন ওসমানী। তিনি ছিলেন ওসমানী পরিবারের প্রথম পুরুষ। ওসমানীর পিতা মরহুম খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ছিলেন একজন উচ্চ শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান।মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর মাতার নাম জোবেদা খাতুন ছিলেন একজন বিদুষী মহিলা। পিতা খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ও মাতা জোবেদা খাতুন ছিলেন দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক-জননী। ওসমানী সাহেব ছিলেন সবার ছোট।
শৈশবে ওসমানীকে তার মা আদর করে আতা বলে ডাকতেন। পরবর্তীকালে তিনি সকলের কাছে আতা নামেই পরিচিত ছিলেন।পিতার চাকরির সুবাদে ওসমানীর দুরন্ত শৈশব কেটেছে সিলেট এবং আসামের বন বনানী ও বন্য পশুপাখির লীলাভূমি পরিবেষ্টিত প্রাকৃতিক পরিবেশে। মায়ের কঠোর তত্ত্বাবধান এবং শৃঙ্খলাবোধে আবর্তিত হয় তাঁর শৈশবের দিনগুলো। খাওয়া-দাওয়া, ঘুমানো, পড়াশুনা-খেলাধুলা, সব কিছুর সময় এবং রুটিন করে দিতেন মা। কখনোবা রুটিনে ব্যত্যয় ঘটলে এতটুকুন বয়সেই তাঁকে শাস্তি পেতে হত। ফলে, ছোট বেলা থেকেই ওসমানী কঠোর অনুশীলন, আদব-কায়দা, শৃঙ্খলাবোধে অভ্যস্ত হয়ে উঠেন।শৈশবে ওসমানীর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় পরিবার থেকেই। কোনো স্কুলে ভর্তি না হয়ে, ঘরে বসে বসেই তাঁর বিদুষী মায়ের অনুশাসন এবং যোগ্য গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে বাংলা ও ফার্সি ভাষায় ওসমানী প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন।
১৯২৯ সালে ১১ বছর বয়সে ওসমানীকে আসামের গৌহাটির কটনস স্কুলে ভর্তি করা হয়। কটন স্কুলে পড়াশুনা শেষ করার পর মায়ের ইচ্ছায় ১৯৩২ সালে সিলেট সরকারি পাইলট স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। এই স্কুল থেকে ১৯৩৪ সালে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাস করেন এবং ইংরেজিতে কৃতিত্বের জন্য “প্রিটোরিয়া অ্যাওয়ার্ড” লাভ করেন।
১৯৩৮ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৩৯ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ফেডারেল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য লাভ করেন। একই সময়ে তিনি রাজকীয় সামরিক বাহিনীতে জেন্টলম্যান ক্যাডেট নির্বাচিত হন। ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে যোগ না দিয়ে তিনি ১৯৩৯ সালের জুলাই মাসে দেরাদুনে ব্রিটিশ ভারতীয় সামরিক একাডেমি থেকে সামরিক কোর্স সম্পন্ন করে রাজকীয় বাহিনীতে কমিশন্ড অফিসার হিসেবে যোগ দেন (অক্টোবর ১৯৪০)। ১৯৪১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। ১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ওসমানী মেজর পদে উন্নীত হয়ে ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক নিযুক্ত হন।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি বার্মা রণাঙ্গনে ব্রিটিশ বাহিনীর অধিনায়করূপে যুদ্ধ করেন। ১৯৪৭ সালে সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসার কোর্স সম্পন্ন করার পর ওসমানী লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে নিয়োগের জন্য মনোনীত হন।ভারত বিভাগের পর ১৯৪৭ সালের ৭ অক্টোবর তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং পরদিনই লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন। ১৯৪৮ সালে তিনি কোয়েটা স্টাফ কলেজ থেকে পিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৯ সালে তাঁকে সেনাবাহিনীর চিফ অব দি জেনারেল স্টাফের সহকারী নিয়োগ করা হয়। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ওসমানী পর পর চতুর্দশ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের নবম ব্যাটালিয়নে রাইফেল কোম্পানির পরিচালক, পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের অতিরিক্ত কম্যান্ডান্ট এবং সেনাবাহিনীর জেনারেল স্টাফ অফিসার পদে কর্মরত ছিলেন। ১৯৫৬ সালে তিনি কর্নেল পদে উন্নীত হন। এরপর তিনি আর্মি হেডকোয়ার্টারে জেনারেল স্টাফ ও মিলিটারি অপারেশনের ডেপুটি ডিরেক্টর নিযুক্ত হন। ১৯৬৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ দশ বছর তিনি এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।আতাউল গণি ওসমানী ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে ওসমানী বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন। স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালের ২৬ ডিসেম্বর তিনি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল পদে উন্নীত হন এবং তাঁর এ পদোন্নতি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর করা হয়। ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল সেনাবাহিনীতে জেনারেল পদ বিলুপ্ত হওয়ার পর তিনি সামরিক বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হন এবং জাহাজ চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌ ও বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন।ওসমানী ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং নতুন মন্ত্রিসভায় ডাক, তার ও টেলিফোন, যোগাযোগ, জাহাজ চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌ ও বিমান চলাচল মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৭৪ সালের মে মাসে ওসমানী মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে একদলীয় সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের বিরোধিতা করে তিনি যুগপৎ সংসদ-সদস্য পদ এবং আওয়ামী লীগের সদস্যপদ ত্যাগ করেন।১৯৭৫ সালের ২৯ আগস্ট রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক আহমদ তাঁকে রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। কিন্তু ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চার জাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পরেই তিনি পদত্যাগ করেন।ওসমানী ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় জনতা পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৭৮ সালে গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট মনোনীত প্রার্থীরূপে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ১৯৮১ সালে জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রার্থী হিসেবে পুনরায় তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৬৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন এবং ২০ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় হযরত শাহজালাল দরগায় দাফন সম্পন্ন হয়।
বঙ্গবীর এমএজি ওসমানী স্মরণে ঢাকায় গড়ে উঠেছে ওসমানী উদ্যান ও স্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশ সচিবালয়ের বিপরীতে ওসমানী মেমোরিয়াল হল। সরকারি উদ্যোগে সিলেট শহরে তার নামে একটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নামকরণ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ওসমানী নগর থানা ও দয়ামীরে করা হয়েছে ওসমানী স্মৃতি যাদুঘর ও গ্রন্থাগার। নামকরণ করা হয়েছে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। ধোপাদীঘির পাড়ে ওসমানীর পৈতৃক বাড়িটি যুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয় পরবর্তী সময়ে যুদ্ধ শেষে তিনি নিজ উদ্যোগে সেখানে বাংলো টাইপ ঘর নির্মাণ করেন।১৯৮৭ সালে ওসমানী জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সিলেটে বঙ্গবীর ওসমানী শিশু উদ্যান, বঙ্গবীর রোডসহ অসংখ্য স্বীকৃতি স্থাপন করা হয়েছে।মরহুম বঙ্গবীর আতাউল গণি ওসমানী এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি তাঁর জীবন কর্মকালীন এবং চিন্তা-ভাবনা দেশ ও জাতির জন্য উৎসর্গ করে অমর হয়ে রয়েছেন এ দেশবাসীর হৃদয়ে।