আমি- বঙ্গবন্ধু জাতির জনক শেখ মুজিবর রহমানের কথা বলছি, যার তর্জনীনির্দেশে সাড়ে সাত কোটি মানুষ একত্রিত হয়েছিল। যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে ত্রিশ লাখ শহিদ হয়েছিল। দু’ লক্ষ মা বোন সম্ভমহানি হয়েছিল। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর আমরা পেয়েছি ওনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ নামে নিজস্ব একটি ভূ-খণ্ড। সেই বঙ্গবন্ধু জাতির জনক বিজাতিদের কাছে খুন হননি, সপরিবারে স্বজাতির কাছে খুন হয়েছিলেন কিন্তু কেন?কেন সেদিন এ খুনে দেশবাসির নীরব সমর্থন ছিল? জানতে হলে সেই ৭২-৭৫ এর শাসন আমল পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তাহলে চলুন সংক্ষিপ্ত আকারে জেনে আসি সেই মহান নেতা খুনের ইতিহাস।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিবের রক্ষী বাহিনীর হাতে ৪০ হাজার ছাত্র , তরুণ , কিশোর নিহত হয়েছিল।
যাকে খুশি তাকে হত্যার আদেশ দিয়েই শেখ মুজিবের রক্ষী বাহিনী রাজপথে অস্ত্র হাতে মানুষ খুন করেছিল। সারা দেশে তান্ডব চালিয়েছিল। ডাকাতি , লুটপাট , ধর্ষণ, জমি দখল, লেখক হত্যা , সাংবাদিক হত্যা , পঙ্গু করে দেয়া সকল মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছিল রক্ষী বাহিনী।রক্ষী বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন – তোফায়েল , মায়া , আমু ,আব্দুর রাজ্জাক , মোহাম্মদ নাসিম শেখ মনি , সহ আওয়ামীলীগের তত্কালীন ক্যাডার বাহিনীর নেতারা। আওয়ামীলীগের আমলে রক্ষী বাহিনীর অত্যাচারে হাজার হাজার বামপন্থি, আওয়ামীলীগের লুটপাটের বিরোধিতাকারী , কমিউনিস্টরা হত্যার শিকার হয়। সে সব হত্যা ছিল হয় রক্ষী বাহিনী, অথবা সরকারী বাহিনীর গুপ্ত হত্যা।জাতীয় রক্ষীবাহিনী একটি নিয়মিত আধা-সামরিক বাহিনী বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে মুজিব বাহিনী ও কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে এই বাহিনীর জন্ম। ঢাকার শেরেবাংলা নগরে এই বাহিনীর সদরদপ্তর স্থাপন করা হয়। ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায় -রক্ষীবাহিনী আনুগত্য করত আওয়ামীলীগ দলের। তাদের ধরন রাজনৈতিক সৈন্যবাহিনী।
পৃষ্ঠপোষক শেখ মুজিবুর রহমান, মাস্কট শেখ মুজিবুর রহমানের তর্জনী। জাতির জন্য নোট- তখন থেকেই প্রথম বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার উৎপত্তি।
১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ বর্তমান প্রজন্মের জন্য একটি কলংকজনক অধ্যায় হিসেবে পরিগণিত হয়ে রয়েছে। ক্ষমতালিপ্সু, দুর্নীতিবাজ আর দেশের প্রতি চরম অবহেলাকারী আওয়ামীলীগ সরকার তখন জনগণের দুঃখ-দুর্দশার দিকে লক্ষ্য না রেখে লক্ষ্য রেখেছিলেন দমননীতির মাধ্যমে কিভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় সে পদ্ধতির দিকে। দেশের মানুষ যখন কংকালসার, ক্ষুধার্ত, উলঙ্গ, অর্ধ-উলঙ্গ তখন মুজিব ৫৫ তম জন্মবার্ষিকী পালন করেন ৫৫ পাউন্ড ওজনের কেক কাটার মাধ্যমে। ‘আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম’ নামক একটি সংস্থা সরকারের অবহেলার জন্য মানবতার খাতিরে শুধু রাজধানী ঢাকায়ই ২৮৬০টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছিল।১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ মহামারীতে না খেয়ে রোগ ব্যাধিতে কংকালসার হয়ে লাখ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করে। কারো কারো হিসাব মতে দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২ লাখের ঊর্ধ্বে। কিন্তু সরকারি হিসাব নগন্য। আজও যদি কেউ ১৯৭২-৭৪ এর পত্রিকার ফাইল খোলে তবে নিশ্চিতভাবে তার শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরা শিউরে উঠবে। মুজিব ও তার সহকর্মীদের তথা আওয়ামীলীগের দুঃশাসন এদেশে একটি কলংকময় ইতিহাস। সে শাসনামলে সম্ভ্রম রক্ষার্থে জাল দিয়ে নিজ শরীরে আবৃত করেছিল বাসন্তীরা।
প্রজন্মের জন্য নোট- জয়নুল আবেদীনের চিত্রকর্ম এবং তত্কালিন বিদেশী সাংবাদিদের ভিডিও ফুটেজ।বাংলাদেশের সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় সংসদীয় সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ২৪শে জানুয়ারি।তখন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের পর বাকশালকে দ্বিতীয় বিপ্লব হিসেবে ঘোষণা করে তা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।সমালোচকদের মতে, কয়েকটি কারণে বাকশাল এত বিতর্কিত ছিল:
১. এক দলীয় শাসনব্যবস্থা, বিরোধিতার কোন অবকাশ নেই।
২. গণমাধ্যম সম্পূর্ণ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে।
৩. রাষ্ট্র, সরকার এবং দল একত্রিত।
৪. সামরিক বাহিনী, পুলিশ, বিচারক, আমলা দলের সদস্য। নোট- গণতন্ত্র ভুলে সরকার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করে ছিল।
অবশেষে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের কালরাতে একাংশ সামরিকবাহিনীর হাতে নিহত হন সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। যবনিকাপাত ঘটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের শাসনব্যবস্থার।কর্ণেল আব্দুর রশিদ বঙ্গবন্ধুর খুনি তিনি বলেন-
আমি আগেই বলেছি,তিনি ভালো প্রশাসন ছিলেন না, কিন্তু তার একমাত্র গুণ ছিল তিনি সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করতে পারতেন।যেহেতু তিনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ব্যাক্তি তাকে বাঁচিয়ে রাখলে আমাদের পক্ষে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়তো।কর্ণেল ফারুক বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি বলেন-
অবশ্যই আমাদের প্রথম পছন্দের ছিল জেনারেল জিয়া। কারণ সে অন্তত: দাগী নয়। অনেক চেষ্টা তদ্বিরের পর ১৯৭৫ সালের ২০ শে মার্চ সন্ধ্যায় আমি তার সাথে দেখা করতে সক্ষম হয়। আমি একজন সিনিয়ার অফিসার, আমি এ ধরণের কাজে জড়াতে পারি না। তোমরা জুনিয়ার অফিসারেরা যদি কিছু করতে চাও- এগিয়ে যাও। তারপর আমরা লনে গেলাম। আমি তাকে বললাম, স্যার আমরা পেশাদার সৈনিক, আমরা দেশের সেবা করি- কোন ব্যাক্তির নয়। আমাদের এই অবস্থার পরিবর্তন করতেই হবে। আমরা জুনিয়ার অফিসারেরা পরিকল্পনা করে ফেলেছি আমরা আপনার সমর্থন চাই, আপনার নেতৃত্ব চাই। জাতির জন্য নোট- মেজর জিয়া সেনাবাহিনীতে একজন প্রিয় ব্যাক্তি ছিল এবং দেশবাসির জন্যও ভরসা ছিল। অফিসারেরা জিয়ার নেতৃত্বের জন্য উন্মুখ ছিল তত্কালিন রাষ্ট্রের হযবরল ব্যবস্থাপনা থেকে মুক্তি লাভের জন্য। বঙ্গবন্ধুর খুন নিয়ে এই স্ট্যাটমেন্টে মেজর জিয়ার সরাসরি কোন সম্পৃক্তা খুঁজে পাওয়া দুরূহ।
১৫ আগষ্ট তত্কালিন বাংলাদেশ বেতার থেকে প্রচার করা হচ্ছিল-দেশের বৃহত্তর স্বার্থে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে, স্বৈরাচারি সরকারের পতন গঠেছে। সেই রেডিও শুনলে উপস্থাপক বারবার স্বতঃফূর্তে উক্ত উক্তি উচ্চারণ করে দেশবাসীকে অবগত করেন।বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি মেজর ডালিম বলেছিলেন-শেখ মুজিব ও তার খুনি সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে। এখন হতে সারাদেশে সামরিক আইন জারি করা হলো। প্রিয় ভাই ও বোনেরা আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন আপনাদের কোন অসুবিধা নেই।শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠভাজন এবং বঙ্গবন্ধুর কেবিনেটের মন্ত্রী খন্দকার মোস্তাক রাষ্ট্রপতির দায়ত্বভার গ্রহণ করে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দানকালে, প্রিয় দেশবাসী ঐতিহাসিক প্রয়োজনে আজ দেশ ও দেশবাসীর বৃহত্তর স্বার্থে নয়া রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব আমাকে গ্রহণ করতে হয়েছে।
একে একে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশবাহিনী, রক্ষীবাহিনী, সকল বাহিনী খন্দকার মোস্তাক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে এবং মোস্তাক সরকারকে সম্মতি দেয় এবং সেদিন বঙ্গবন্ধু কেবিনেটের প্রায় সকল মন্ত্রী মোস্তাক সরকারকে সমর্থন দিয়ে শপথ গ্রহণ করেছিলেন।হাসানুল হক ইনু তত্কালীন সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- শেখ মুজিবর রহমান গণতান্ত্রিক রাজনীতে অক্ষম ছিল। সে বিরোধী আন্দোলনে ভীত হয়ে পড়তো। সে মানুষের উপরে একতফরা জোর জবরদস্তি চালাচ্ছিল। তার মধ্যে সমলোচনা বা বিরোধীতা সহ্য করার ক্ষমতা ছিলনা।১৫ আগষ্ট শেখ মুজিবের মৃত্যুতে কেউ কোন টু শব্দটিও করেনি। যে দেশবাসী তার ডাকে পাকিস্থানিদের বন্দুকের নলে পতঙ্গের মত যাপিয়ে পড়েছিল কিন্তু দুঃখের বিষয় সেদিন সেই দেশবাসী নীরব ছিলেন। যদি কোন স্বামী স্ত্রীর নূন্যতম ভরণ-পোষণও না করতে পারে তখন স্ত্রী বলতে বাধ্য হয় এমন স্বামী থাকার চেয়ে না থাকায় ভালো। আবার কেউ কেউ মুক্তির জন্য মৃত্যুও কামনা করে সেদিনও তাই হয়েছিল পর্যবেক্ষণে মিলে। জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল তা জ্বলজ্বল। অর্থাৎ বুঝায় যায় সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে শেখ মুজিব সরকার উৎখাতের মধ্যে দেশ আরেকবার আজাদ হয়ে ছিল। উপরের বক্তব্য থেকে বেশ পরিষ্কার শেখ মুজিবরের মৃত্যুর কারণ তত্কালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, দুর্নীতি, দুর্ভিক্ষ, ক্ষমতায় টিকে থাকার দূরবীসন্ধি ও বাকশালের মাধ্যমে একনায়কতন্ত্র এবং সর্বশেষ অদক্ষতায় দায়ি।