আমরা আজ আধুনিক সমাজের বাসিন্দা। এই সমাজের বাসিন্দা হিসেবে একটি বৈষম্যহীন সমাজের প্রত্যাশা করতেই পারি। কারণ আমরা আজ কাগজে কলমে অত্যন্ত সভ্য জাতি হিসেবে পরিচিত। তারপরেও আমাদের মনের অন্ধকার দূর করতে পারিনি। কালো-ফর্সা, বর্ণে-বর্ণে, গোত্রে- গোত্রে মানুষের মাঝে ভেদাভেদ। একজন আরেকজনকে ঘৃণা করছে কেবল গায়ের রংয়ের কারণে- আজকের সমাজে একথা ভাবা যায়! কালো আর ধলো বাহিরে কেবল ভেতরে সবার সমান রাঙা- মানুষ জাতি কবিতায় মানুষের ভেদাভেদ দূর করে সব মানুষকে সমান বানিয়েছেন। বর্ণবাদ শব্দটি দ্বারা মূলত শরীরের রং দ্বারা মানুষে মানুষে ভেদাভেদ বোঝায়। সেই অতীত কাল থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক সমাজেও বর্ণবাদ আমাদের অস্থিমজ্জায় গেঁথে আছে। আমরা সম্ভবত এই বর্ণবাদের বিষয়টি পুরোপুরি দূর করতে চাই না। সাদা চামড়া কালো চামড়া নিয়ে সারা পৃথিবীতেই এক অদ্ভুত বৈষম্য চালু ছিল এক সময়। কালো চামড়ার লোকদের দাস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রভু আর ভৃত্যেও সম্পর্ক ছিল কেবল গায়ের রংয়ের ওপর ভিত্তি করে। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে উপন্যাস, সিনেমা। নেলসন ম্যান্ডেলা নামটি আজ সবার কাছে পরিচিত। তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন এই বর্ণবাদের বিরুদ্ধে।
তার জন্য তাকে কম যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়নি। অদ্ভুত সব বৈষম্যে ভরা এই সমাজটা। এখানে চামড়ার রঙে বৈষম্য, জাতিতে জাতিতে বৈষম্য, গোত্রে গোত্রে বৈষম্য, আকারে বৈষম্য, আর্থিক ক্ষমতায় বৈষম্য এরকম আরও বহু বৈষম্য আমাদের এই সুন্দর ধরণীতে। অথচ কি আশ্চর্য মিল সবার মধ্যে! সবাই এই পৃথিবী নামক গ্রহটির মানুষ বলে পরিচয় দেই। আমাদের সবার দেহ একই রকম উপাদানে গঠিত, রক্তের রং লাল, খাদ্য খেয়ে সবাই জীবন ধারণ করি, গঠন প্রকৃতিও এক। তবু আমরা বৈষম্য করি, নিজেদের আলাদা করে চেনানোর চেষ্টা করি, নিজেদের বীরত্ব জাহির করি। বর্ণবাদ সেই দৃষ্টিভঙ্গি, চর্চা এবং ক্রিয়াকলাপ যেখানে বিশ্বাস করা হয় যে মানুষ বৈজ্ঞানিকভাবেই অনেকগুলো গোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং একইসঙ্গে বিশ্বাস করা হয় কোন কোন গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর চেয়ে নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য উঁচু অথবা নিচু; কিংবা তার ওপর কর্তৃত্ব করার অধিকারী অথবা বেশি যোগ্য কিংবা অযোগ্য। তবে বর্ণবাদের সঠিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করাটা কঠিন। কারণ গবেষকদের মধ্যে গোষ্ঠী ধারণাটি নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। বর্ণবাদ কখনো গায়ের রং, কখোনো আঞ্চলিকতা আবার কখোনো গোত্র নিয়ে বোঝানো হয়ে থাকে। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা দক্ষিণ আফ্রিকার বিখ্যাত নেতা ও আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের অন্যতম নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। যে মানুষটি এই বৈষম্য দূর করতে বহু নির্যাতন সহ্য করেছেন। ১৯৬২ সালে তাকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকার গ্রেপ্তার করে ও অন্তর্ঘাতসহ নানা অপরাধের দায়ে যাবতজীবন কারাদন্ড দেয়। দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকার সে সময় একটি আইন প্রণয়ন করেছিল, যেখানে বলা হয়েছিল কৃষ্ণাঙ্গদের সব সময় তাদের পরিচয়সংক্রান্ত নথিপত্র বহন করতে হবে। ১৯৬০ সালের ২১ মার্চ বর্ণবৈষম্যের প্রতিবাদে জড়ো হন কৃষ্ণাঙ্গরা। পুলিশ একপর্যায়ে তাদের ওপর গুলি ছোড়ে। এ ঘটনায় নিহত হন ৬৯ জন ও আহত হন ১৮০ জন। যুগে যুগে এরকম বহু বৈষম্যের প্রতিবাদের আন্দোলনে পুলিশ গুলি ছুড়েছে। নেলসন ম্যান্ডেলা মুক্তি পায় ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রম্নয়ারি। তার দীর্ঘ সংগ্রামের ফলস্বরূপ দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান ঘটে এবং সব বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে ১৯৯৪ সালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। শেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ নিয়ে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব শেষ হয়। কিন্তু তার পরেও আদৌ আজকের পৃথিবীতে তা শেষ হয়েছে কি? আমাদের দেশে প্রায় দুশ বছর ব্রিটিশরা শাসন করেছে। সাদা চামড়ার সাহেব বাবুরা বাঙালিদের খুব একটা আপন করতে পারেনি। একটা দূরত্ব ছিল কেবল চামড়ার রংয়ের আর ভাষার কারণে। আজও ফর্সা কালোর সামাজিক পার্থক্য শেষ হয়ে যায়নি। বরং আধুনিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা আরও প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। কালো হওয়ার দায় যেন ব্যক্তির নিজস্ব আর ফর্সা হওয়ার কর্তৃত্ব যেন সবটুকুই তার।