লক্ষ্মীপুর জেলা ও রায়পুর উপজেলায় মেঘনা নদীতে কাঙ্ক্ষিত ইলিশের দেখা নেই। ভরা মৌসুমেও জেলেদের জালে ধরা পড়ছে না ইলিশ। এতে অলস সময় পার করছেন জেলে ও আড়তদারেরা। নদীতে মাছ না মেলায় অনেকেই হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন।
স্থানীয় জেলেরা বলছেন, নদীতে জাল ফেলেও মিলছে না প্রত্যাশিত ইলিশ। রোদ-বৃষ্টিতে কষ্ট করে নদীতে গেলে পাওয়া যাচ্ছে সামান্য কিছু মাছ, যা দিয়ে নৌকার জ্বালানি খরচও ওঠে না। ফলে নদীতে যেতে আগ্রহ হারাচ্ছেন অনেক জেলে। মাছঘাটগুলোয় নেই সেই চিরচেনা সরগরম ভাব। বাজারে ইলিশের সরবরাহও প্রায় শূন্য। যাও কিছু পাওয়া যাচ্ছে, তার দাম আকাশছোঁয়া—এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২৮০০ থেকে ৩০০০ টাকায়।
চরবংশীর চরকাছিয়া-হাজিমারা গ্রামের মেঘনাপাড়ের জেলেরা মেঘনায় ইলিশ ধরেন। চরবংশীর ফাঁড়ি থানা সংলগ্ন ইলিশ ঘাটের পাশে মেঘনার কূলে চান্দার খাল নামক মাছ ঘাট এলাকায় হাঁটতে হাঁটতে কথা হচ্ছিল- জহির, কামাল মাঝি ও হারিছ খাঁ মাঝিসহ কয়েকজন জেলের সঙ্গে।
হারিছ মাঝি বলেন, গত চার দিন আগে বড় আশায় নদীতে গিয়েছিলাম। কিন্তু যেমন আশা করেছি তার ধারে-কাছে যাওয়ার চিন্তাও করতে পারিনি। চার দিনের খরচ চার হাজার টাকা। ইলিশ পাইছি তিন হালি। বিক্রি করেছি আড়াই হাজার টাকা। স্বাভাবিকভাবে ইলিশ থাকলে কম করে হলেও ১৫-২০ হাজার টাকা রোজগার হইতো।
তিনি বলেন, আমার জেলে কার্ড আছে। অভিযানের সময় চাল পাইছি। কিন্তু ৪০ কেজি চাল দেওয়ার কথা থাকলেও চাল পাইছি ৩৫ কেজি। ২ মাসও আমাদের সংসার চলে নাই?
ইলিশের আকাল চিত্রের দেখা মেলে আলতাফ মাস্টার ও সাজু মোল্লার মাছঘাটে গিয়ে। আড়ত ব্যবসায়ীদের অনেকেই বলছেন, এ সময় মেঘনায় পলি মাটি ও ভাটার কারণে নদীতে ইলিশ নেই। বরিশালের দিকে মোটামুটি ইলিশের দেখা মিলছে।
মেঘনায় ইলিশসহ অন্যান্য মাছ ধরার সঙ্গে মেঘনাপারের বহু মানুষের জীবন-জীবিকা চলে। মেঘনার জেলে ও মেঘনাপারের মৎস্য ব্যবসায়ী, বরফ কারখানার মালিক-শ্রমিক, স্থানীয় দোকানপাটের ব্যবসায়ীদের জীবিকা কেবল ওই মেঘনা নদীর ওপরই নির্ভর।
চান্দার খাল এলাকার মিজান সর্দার। বয়স ৪২ বছর। স্ত্রী-এক মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে তার সংসার। মেঘনাপাড়েই চায়ের দোকান। এতেই জীবন বাঁচে। তিনি বলেন, নদীর জেলেদের আয় থাকলে তাদের আয়। নদীতে গিয়ে তারা যদি মাছ না পান, তাহলে দোকানের বেচাকেনাও বন্ধ। বেচাকেনা না হলে তাদের আয়-রোজগারও হবে না। তারাও বলতে গেলে নদীতে মাছ পাওয়ার ওপর নির্ভরশীল। তাছাড়া জেলেদের বাকিতে সদাই (পণ্য) দিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখাও সম্ভব না।
লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্যজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি মোস্তফা বেপারী বলেন, গত দুই মাস (১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল) নদীতে মাছ ধরা বন্ধ ছিল। গত চার দিন কাঙ্ক্ষিত ইলিশ ধরা না পড়ায় সবার মাঝে হতাশার কালো ছায়া নেমে এসেছে। তাছাড়া অভিযান চলাকালীন জেলেদের জন্য বরাদ্দকৃত কার্ডের সংখ্যা রায়পুর অঞ্চলে কম রাখা হয়। যার জন্য এখানের বহু জেলেই অভিযানের সময় মানবেতর জীবন পার করে থাকেন। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, নদীতে জীবিকানির্ভর মানুষের জন্য কোনো বরাদ্দও নেই। নদীতে গিয়ে ইলিশ না পেলে সংসার চলে না। অসহায় অবস্থায় থাকে। মাছ ধরতে না পেরে অন্য পেশায় মনোযোগী হচ্ছেন জেলেরা।
রায়পুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা এমদাদুল হক বলেন, এ সময়ে নদীতে একটু ইলিশ কম থাকে। তাছাড়া নদীতে পানি কম, চর জেগেছে। বৃষ্টি হলে আবার প্রচুর ইলিশ ধরা পড়বে; যা ইলিশ হয় তা চাঁদপুর হয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রাম চলে যায়। সকালে ছোট মাছগুলো গ্রামের বাজারগুলোতে পাওয়া যায়। জেলেদের কাঙ্ক্ষিত আশা পূরণ হয়নি।
এ সময় জেলে সম্প্রদায়ের জন্য কোনো বাজেট আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, চার মাসে প্রায় পাঁচ হাজার জেলেকে জনপ্রতি ৪০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। দুই মাসের অভিযানে ১১৫ টি মোবাইল কোর্টে ৪৩টি মামলা করা হয়েছে। জরিমানা করা হয় ২ লাখ ১৬ হাজার টাকা। অবৈধ জাল পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয় প্রায় ২০ লাখ মিটার।
উল্লেখ্য, লক্ষ্মীপুরে প্রায় ৫০ হাজার ২৫২ জেলে পরিবার রয়েছে। তার মধ্যে লক্ষ্মীপুর সদরে সাত হাজার ৫১৮, রায়পুরে সাত হাজার ৫৫০, রামগতিতে ২০ হাজার ৩৬০ ও কমলনগর উপজেলায় ১৪ হাজার ১০০ কার্ডধারী জেলে পরিবার রয়েছে।