1. admin@desh-bulletin.com : নিজস্ব প্রতিবেদক : দৈনিক প্রতিদিনের অপরাধ
বৃহস্পতিবার, ০৮ মে ২০২৫, ০৬:৪৮ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম দলের বগুড়া সারিয়াকান্দি উপজেলা আহবায়ক কমিটি অনুমোদন সুন্দরবনে বিষাক্ত থাবা, আটক ৪ মাছ শিকারী বিশেষ চিহ্ন থাকলে দাড়াতে হবেনা লাইনে ছাগল পালন করে স্বচ্ছল সাইফুর ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা, একই পরিবারের তিনজনসহ নিহত ৫ ঠাকুরগাঁওয়ে “মির্জা রুহুল আমিন” স্মৃতি টি-২০ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট উদ্বোধন ডোমার উপজেলায় নতুন ইউএনও শায়লার যোগদান এবং নাজমুলের বিদায় সংবর্ধনা সুন্দরবন থেকে হরিণের মাংসসহ নৌকা জব্দ আমতলীর চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার ২ আসামি গ্রেপ্তার বদলগাছী বিষ্ণুপুর ব্রিজের নিচে পরিত্যক্ত মাংস উদ্ধার, জনমনে শঙ্কা

লক্ষ্মীপুরে সয়াবিন কৃষকদের মুখে শুধু ক্লান্তি আর আতঙ্ক ফসল তুলতে গেলে প্রতিনিহত চলছে রাজনৈতিক হুমকি ও চাঁদাবাজি

মুশফিকুর রহমান সৈকত
  • প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার, ৮ মে, ২০২৫
  • ২২ বার পড়া হয়েছে
মেঘনার বুক চিরে উঠে আসা চরগুলোতে এখন সোনালি সয়াবিনের জোয়ার। লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার চর কাছিয়া, চর ঘাসিয়া, চর কানিবগা, চর জালিয়া, টুনির চরসহ ছয়টি চরজুড়ে চোখ ধাঁধানো সয়াবিনের শস্যখেত। কিন্তু এ সৌন্দর্য এখন আর কৃষকের মনে আশার আলো জ্বালাতে পারছে না। কারণ, ফসল কাটা নিয়ে রাজনৈতিক হুমকি, চাঁদাবাজি এবং অনিশ্চিত বাজারদরে হতাশ কৃষকের মুখে শুধু ক্লান্তি আর আতঙ্ক।
কৃষক হেনজু মিয়া বলেন, “গাছ ফল দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু কাটতে গেলেই ভয়—কেউ এসে ধাওয়া করে, কেউ আবার টাকা চায়। নিজের ফলানো ফসলেই যেন আমরা অপরাধী হয়ে গেছি।”
চরের জমিগুলোর অধিকাংশই সরকারী খাস খতিয়ানভুক্ত। বিগত এক দশকে রাজনৈতিক পালাবদলে এই জমিগুলো দখলবাজ নেতাদের হাতবদল হয়েছে বারবার। এক সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের দখলে থাকা জমিগুলো এখন নিয়ন্ত্রণ করছে বিএনপির দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী। চরভিত্তিক রাজনীতি আজ কৃষকের জীবিকাকে অস্তিত্বসংকটে ঠেলে দিয়েছে।
চরের কৃষক রফিজ সরদার জানান, “প্রতি একরে ১০-১৫ হাজার টাকা চাঁদা না দিলে জমির ফসল কাটতে দেওয়া হচ্ছে না। যারা দিচ্ছে, তারা কাটতে পারছে। যারা দিতে পারছে না, তাদের গাছ পেকে গেলেও মাঠে দাঁড়িয়ে আছে।”
বিএনপির দুই পক্ষের দ্বন্দ্বে রক্তপাতও ঘটেছে। গত ৭ এপ্রিল সংঘর্ষে নিহত হন দুজন, আহত হয় বেশ কজন। ঘটনাটি জমির দখল ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ছিল বলে জানায় স্থানীয় প্রশাসন। এ সংঘাতের নেতৃত্বে ছিলেন উত্তর চর বংশী ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি মো. ফারুক কবিরাজ ও কৃষক দলের উপজেলা সদস্যসচিব জি এম শামীম—দুজনই এখন পলাতক, এবং হত্যা মামলার আসামি।
রায়পুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইমরান খান বলেন, “ফসল যিনি চাষ করেছেন, ফসলের মালিক তিনিই। চাঁদা বা ভয়ভীতি মেনে নেওয়া হবে না। আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মাঠে আছি।”
রায়পুরে এবার রেকর্ড ৭,৫৪০ হেক্টর জমিতে সয়াবিন আবাদ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেলেও ফলন প্রত্যাশিত হয়নি। খরার কারণে গাছ ছোট হয়েছে, শুঁটি কম এসেছে, দানাও ছোট। প্রতি বিঘায় কৃষকের খরচ ৮,০০০-৯,০০০ টাকা হলেও, অনেকেই ৬ মণের নিচে ফলন পেয়েছেন।
বর্তমানে বাজারে প্রতি মণ সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১,২০০-১,৩০০ টাকা দরে। ফলন ও দামে মিলিয়ে লাভ তো দূরের কথা, মূলধনও উঠছে না। কৃষক হুমায়ুন বলেন, “ফড়িয়া যা দিছে তাই নিছি, বিকল্প নাই। যদি সরকার ধানের মতো সয়াবিন কিনতো, আমরা বাঁচতাম।”
বাজারে তেলের দামে মন্দা ও পূর্বের সয়াবিন মজুদের কারণে চাহিদাও কম। স্থানীয় পাইকার মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, “চাহিদা কম, গত বছরের সয়াবিন এখনো গুদামে পড়ে আছে। নতুন মাল কিনে আমরা ঝুঁকি নিতে পারছি না।”
সয়াবিন চাষ শুধু অর্থনীতি নয়, চরাঞ্চলের মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ঋণের বোঝা শোধ করতে না পারলে কৃষককে গরু, ছাগল বিক্রি করে দিতে হয়। সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়, স্কুলের ফি বাকি পড়ে। স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষক জানান, “লোকসান হলে ছাত্ররাই মাঠে যায়, বইয়ের পাতা ফেলে দেয়।”
একজন কৃষক কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “এই ফসল যদি আমাদের ঘাম নেয়, চোখের পানি নেয়, আর কিছুই না দেয়, তাহলে আর কিসের চাষাবাদ?” এনজিওর উচ্চ সুদের ঋণ, মহাজনের দাদন আর বাজারের সংকট কৃষকের জীবনে এক অব্যাহত চাপের নাম।
লক্ষ্মীপুরের সয়াবিন শুধুই একটি পণ্য নয়, এটি দেশের তেল শিল্প, পোলট্রি খাত, পশুখাদ্য এবং রপ্তানি সম্ভাবনার অন্যতম চালিকাশক্তি। অথচ এই খাতের মূল চালিকাশক্তি কৃষকেরাই আজ অবহেলিত, অবরুদ্ধ এবং আর্থিক দৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত। এই বাস্তবতায় রাষ্ট্রের দায়িত্ব হওয়া উচিত খাস জমির স্বচ্ছ তালিকা তৈরি ও দখলমুক্ত করা, কৃষকদের জন্য সরকারি ক্রয়মূল্য নির্ধারণ, ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য কমাতে সরাসরি কৃষিপণ্য কেনার ব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে কৃষিকে মুক্ত রাখা, চরাঞ্চলের কৃষকদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ ও প্রশিক্ষণ সুবিধা
চরাঞ্চলের কৃষকেরা এখনো মাঠে তাকিয়ে আছেন, চোখে ভেসে উঠছে শ্রম, শঙ্কা আর সাধনার ফল। রাষ্ট্র কি এবার পাশে দাঁড়াবে? না কি সয়াবিনের এই মাঠ কেবলই হয়ে থাকবে শোষণের প্রতিচ্ছবি, যেখানে কৃষকের ঘাম ঝরে, কিন্তু অধিকার হারায়?
এ বিভাগের আরো সংবাদ
© দেশ বুলেটিন 2023 All rights reserved
Theme Customized BY ITPolly.Com