মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা,
সালাম ও শুভেচ্ছা আপনাকে ও আপনার মাধ্যমে আপনার পরিষদকে।
এই পত্র উপদেশ বাণী নয়, উপলব্ধি ও পর্যবেক্ষণ থেকে সতর্ক বার্তা।
পৃথিবী নিয়ে অনেক ভেবেছেন। এইবার বাংলাদেশকে নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবুন। বিশ্ব আপনাকে অনেক দিয়েছে,আপনিও দিয়েছেন, বেঁচে থাকলে আরো দিবেন কিন্তু স্বদেশকে দেওয়ার তৃপ্তি ও গৌরব অন্য সবকিছু থেকে ভিন্ন ও অনন্য। মাইকেল মধুসূদন দত্তের বিদেশপ্রীতির করুন পরিণতি এবং স্বদেশ প্রীতির আক্ষেপ আমরা সবাই জানি।জন্ম ও মৃত্যুর অমোঘ টান মাতৃভূমির চেয়ে কারোরই বেশি থাকতে পারে না।
আপনি বাংলাদেশ সরকারের তথা জাতির দায়িত্ব নিয়েছেন নয় মাস গত হলো। ইতিবাচক পরিবর্তনের যাত্রায় এই সময়টুকু পর্যাপ্ত না হলেও একেবারে কম নয়। আপনার ঈর্ষণীয় যোগ্যতা, অসাধারণ মেধা,নেতৃত্ব ও প্রেরণা দানের বিশ্ব পরিচিতি, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও প্রায় সার্বজনীন গ্রহনযোগ্যতা দেশ পূণর্গঠনে জনমনে আকাশ সমান আঁকাঙ্খার চারা তৈরি করেছে।তবে এই আঁকাঙ্খার বীজ রোপিত হয়েছে জুলাই আগস্ট গণ অভ্যুত্থানে। সেই আকাঙ্ক্ষার ধারে কাছে আপনি এখনো যেতে পারেননি এ কথা তিক্ত হলেও সরল সত্য। যাওয়ার যোগ্যতা আপনার আছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই বলেই মানুষ এখনো সংযম ও ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে চলেছে।এই ধৈর্যের বাঁধে ফাটল ধরলে আপনার বিশ্বমানের মেধা ও দৃষ্টি ভঙ্গি বিফলে যাবে,সম্মান হারাবেন জীবনে যা পেয়েছেন তার চেয়ে অনেক বেশি।এত ত্যাগ,রক্তক্ষয়,প্রাণনাশ, অঙ্গহানি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ পাচারজনিত অপচয়ের বিনিময়ে রাষ্ট্র মেরামতের কাঙ্ক্ষিত যে সুযোগ তৈরি হয়েছে তা হাতছাড়া হলে আপনিই হবেন সবচেয়ে বেশি দায়ী ও দোষী। জাতি হবে ক্ষতিগ্রস্ত,আশাহত ও নিরাশ।এই জাতির উপর নিপীড়ন নির্যাতনের আইনগত বৈধতা পাবে পরবর্তী সরকার ফলে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা থেকে যাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য অধরা।
প্রিয় মাতৃভূমি আজো বিপর্যস্ত।অসৎ ও বিবেকবর্জিত ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কৃত্রিম পণ্য সংকট, পেশিশক্তির আধার রাজনৈতিক দলগুলোর বিপথগামী ও সুযোগসন্ধানী নেতাকর্মীদের লাগামহীন চাঁদাবাজি,বিগত দিনের অপরাধকাতর সরকারি কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সাথে কর্তব্য পালনে শিথিলতা,আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি ও ক্ষেত্রবিশেষে নেতাপান্ডাদের দৃশ্যমান চাপ সামগ্রিক পরিস্থিতিকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাতে ভীষণ ভূমিকা রাখছে। তদুপরি,ভিনদেশের রক্তচক্ষু, স্বদেশের অস্থির লোভাতুর গোষ্ঠীর লোলুপ দৃষ্টি, পরাজিত পক্ষের কারসাজি আর নবাগতদের সর্বগ্রাসী মনোভাব আপনার কর্মপথের সুকঠিন থ্রেট।অধিকতর ভালো, মঙ্গল, উন্নয়ন, সুশাসন, যাবতীয় সংস্কার, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সুরক্ষা,মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মতো মজবুত ভিত্তির সামরিক শক্তি অর্জন এবং সর্বোপরি একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন আয়োজন আপনার সরকারের কাছে গণমানুষের প্রাণপণ প্রত্যাশা ও দাবি।
এ লক্ষ্যে জনগণের এক অলিখিত, অপ্রাতিষ্ঠানিক কিন্তু বিশাল ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত হয়ে অলৌকিকভাবে আপনি রাষ্ট্র পরিচালনা সুযোগ লাভ করেছেন যা স্বপ্নের মতো। এমন সুযোগ আপনার জীবনে দ্বিতীয়বার আসার ১% সম্ভাবনাও আর নেই। অতএব, দায়িত্ব পালন শেষে নিন্দিত না নন্দিত হবেন তা নির্ধারিত হবে আপনার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টা, প্রয়াস ও কর্মফলের সফলতায় বা ব্যর্থতায়। অতএব, জনগণের জন্য নির্ঝঞ্ঝাট সরকারি পরিসেবা,সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, নাগরিক অধিকার, মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার,পক্ষপাতহীন প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড এবং ন্যায়ভিত্তিক বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করুন। যেহেতু আপনার কোনো দল নেই, নেতাকর্মীদের মূল্যায়নের নামে অনৈতিক ও গর্হিত সুযোগ সুবিধা দেওয়ার অবকাশও তাই নেই।ফলে,একটি রাজনৈতিক সরকার যে সকল দুষ্টু বাস্তবতায় দুষ্ট সেসব থেকে আপনি শতভাগ মুক্ত থাকার বিপুল সম্ভাবনা ও উপায় আছে।নিজ দল, গোষ্ঠী, অনুসারী অথবা আত্মীয় স্বজনের উৎপাত নেই বিধায় অন্যায়-অনাচারীদের সাথে, দুষ্কৃতকারীদের সাথে আপোষের শংকাও নেই।তবে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুরণো ও বৃহৎ দু-একটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় এবং বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের লাগামহীন চাঁদাবাজি, দখলবাজি, তদবির বাণিজ্য , প্রশাসনিক ও বিচারিক কার্যক্রমে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা আপনার ঘোষিত শান্তির ও ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের পথে প্রধানতম অন্তরায়। বিগত কয়েক দশকে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠা চাঁদাবাজি ও দখলবাজির নগ্ন ধারাবাহিকতায় আজকের বাংলাদেশে সেই সংস্কৃতি বহুমাত্রিক ও বহুগুণে প্রকাশ,বিকাশ ও বিস্তার ঘটে চলেছে।এই অসুস্থ আয়-রোজগারের চর্চা কঠোর হস্তে বন্ধ করতে না পারলে সুশাসনের লক্ষ্য অর্জন কিছুতেই সম্ভব না।
আগষ্টের সেই ভয়াবহ শূন্য থেকে নতুন করে নিজের মতো শুরু করার যে বাস্তবায়নযোগ্য সুযোগ আপনাকে জাতি দিয়েছে তা বিশ্বের খুব কম সংখ্যক নেতারাই পেয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি,দূ্র্বৃত্তায়ন রোধ, নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ,পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার,প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি প্রদান এবং সর্বব্যাপি দুর্নীতি বন্ধ করতে ব্যর্থ হলে আপনার ক্ষমতা গ্রহন দেশপ্রেমের পরিচায়ক না হয়ে বরং ক্ষমতালিপ্সার সুনিপুণ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আপনিই আপনার সংজ্ঞা নির্ণয় করবেন আপন কর্মচেষ্টায়।এই ক্ষেত্রে জাতি কেবলই নীরব বিচারক। অতএব,সুস্থ রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার নতুন সূর্যোদয়, আমূল সংস্কার, নিখাদ গণতন্ত্রের রুচিবোধ জাগ্রত করণের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও শৌর্যবীর্যের সামরিক সক্ষমতার দ্বার উন্মোচনের সদিচ্ছা আপনাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে ।আর এসবের অনুপস্থিতি বা ব্যত্যয় আপনাকে ধূলায় নামিয়ে আনতে পারে।এখন সিদ্ধান্ত ও ভূমিকা আপনার।
দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের সমর্থনপুষ্ট হয়ে এবং দেশব্যাপী ছাত্রজনতার স্বতঃস্ফূর্ত অভিবাদনে প্রধান উপদেষ্টার যে সুকঠিন দায়িত্ব পালনের বৈধতা আপনি পেয়েছেন ইতিহাসে তা বিরল।স্বপ্ন ও লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হলে এই জাতির রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক মুক্তির আশা সুদূরপরাহত হবে।
আপনি দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি নিয়ে চটকদারি কথা বলেছেন। ভারতের সেভেনে সিস্টার্স বিচ্ছিন্ন করার প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েছেন। সামরিক শক্তিতে ইঁদুর হয়ে ভারত সিংহের কানে কেনো সুড়সুড়ি দিলেন ? এখন,সেভেনে সিস্টার্সের যে কোনো জায়গায় সন্ত্রাসী হামলার নাটক সাজিয়ে বাংলাদেশকে আসামীর করলে সামলাতে পারবেন ? কাশ্মীর নাটকের পাল্টা যে ব্যবস্থা পাকিস্তান করতে পেরেছে আমরা কি সেই সক্ষমতা অর্জন করেছি ? সামরিক বাহিনীকে আধুনিকায়ন, শক্তিশালীকরণ ও বর্ধিতকরণের কী কী পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত নিয়েছেন জাতি হিসেবে আমাদের জানার অধিকার অবশ্যই আছে। শুধু কথার কূটচালে যুদ্ধ হয় না,যুদ্ধ করতে তাগুদ লাগে। পররাষ্ট্র নীতিতে অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত নিলে ভবিষ্যতে কঠিন মাশুল গুনতে হতে পারে। ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক,উগ্র ও আগ্রাসী সংগঠন বিজেপির ভারত সরকার যে কোনো উম্মাদনায় জড়াতে প্রস্তুত ।তারা অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন দেখে, সেই স্বপ্নের নিকট সীমান্তেই আমাদের বসবাস। স্বপ্ন ভঙ্গ করার বা নস্যাৎ করার কী কী সরঞ্জাম আমরা যোগাড় করেছি? সিংহের সামনে দাঁড়িয়ে হরিণ যদি বলে আমি শান্তিকামী,আমি শান্তি চাই-সিংহের নিকট এই দাবি কতটুকু গ্রহনযোগ্যতা পাবে? তার মানে আমি নতজানু হতে বলছি ? না।সক্ষম কিংবা সমকক্ষ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কৌশলী হতে বলছি। অপ্রয়োজনীয় বাক্য ব্যয়ের চাইতে শক্তি সঞ্চয়ে মনোযোগী হওয়াই এখন বিচক্ষণতার পরিচায়ক হবে।
পরিশেষে, বিনয়ের সাথে বলছি- এই আত্মমর্যাদাশীল ও বীরের জাতিকে অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদের সম্মুখীন করবেন না। সম্ভাবনাময় এই দেশ ও জাতিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে উজ্জীবিত করুন, তারুণ্যের শক্তি,সাহস ও মেধাকে দেশ গঠনে ও প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত করুন, রাজনীতিকে পরিশুদ্ধ করুন, শাসনব্যবস্থা কে জনকল্যাণমুখী করুন।ধনী ও শক্তিশালী জাতির দিকে কেউ চোখ তুলে তাকাতে সাহস করে না।বারবার আশাহত এই সহজ-সরল আবেগী জাতিকে অসাধারণ কিছু দিন। প্রিয় বাংলাদেশকে অভূতপূর্ব কিছু দিন, সুবর্ণ ইতিহাসে থাকবেন।
লেখক:কবি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।