বাংলাদেশের রাজনীতি বর্তমানে এক সংকটময় ও গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে দেশ রাজনৈতিক টানাপোড়েন, স্বৈরতন্ত্রের অভিযোগ এবং গণতান্ত্রিক অধিকার সংকোচনের মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে। ২০২৪ সালের আগস্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। তবে এই সমাপ্তি আসলে একটি নতুন সংকটের সূচনা করে, যা দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।
দীর্ঘদিনের ছাত্র আন্দোলন এবং জনগণের তীব্র ক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনা সামরিক সমর্থন হারিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এই শূন্যতা পূরণ করতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়, যার মূল লক্ষ্য গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। কিন্তু এই পরিবর্তন কি সত্যিই গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথ সুগম করবে, নাকি বাংলাদেশ নতুন ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতার দিকে ধাবিত হবে?
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি ছিল তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে পরিচালিত গণআন্দোলন। বিশেষ করে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০১৮ সালে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বিস্তৃত ও ব্যাপক গণআন্দোলনে রূপ নেয়।
শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া এই আন্দোলন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাড়িয়ে তোলে। রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি, এবং দমনমূলক নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়। দীর্ঘদিনের দমন-পীড়ন, গুম-খুন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের সমর্থন এই আন্দোলনকে আরও বেগবান করে তোলে।
সরকারের পক্ষ থেকে আন্দোলন দমন করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়, যার ফলে হাজার হাজার আন্দোলনকারী গ্রেফতার হন এবং ৩০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হন। কিন্তু দমন-পীড়ন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে এবং সরকারবিরোধী আন্দোলনকে আরও ব্যাপক করে তোলে। এই ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের ফলশ্রুতিতে শেখ হাসিনার সরকার চাপে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত তার পদত্যাগের মাধ্যমে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে।
শেখ হাসিনার শাসনের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করলেও এটি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে।
দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সংকুচিত গণতান্ত্রিক পরিবেশ পুনঃস্থাপন করা এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি, এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য বড় পরীক্ষা।
দেশের অভ্যন্তরীণ বিভাজন দূর করা এবং প্রতিবেশী ভারতের রাজনৈতিক প্রভাব মোকাবিলা করা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে ভারতের ভূমিকা বরাবরই বিতর্কিত ছিল। বর্তমান সরকার কীভাবে এই আন্তর্জাতিক চাপে ভারসাম্য বজায় রাখবে, তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
শেখ হাসিনার পতনের পর বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কাজ করছে, তবুও রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সহিংসতার ঝুঁকি রয়ে গেছে।
শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা বিতর্ক শুরু হয়েছে। ভারতের সরকার ইতিমধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করেছে, যা নতুন রাজনৈতিক উত্তেজনার সৃষ্টি করতে পারে।
এদিকে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্পর্কে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা রকম প্রচারণা চালিয়ে পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চলছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের নতুন সরকারের উচিত একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে এবং একটি দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি শান্তিপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করতে চাইলেও দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সহজ হবে না। দেশটি এখনো রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত এবং পুরনো দ্বন্দ্ব নতুন রূপে ফিরে আসার আশঙ্কা রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, নতুন সরকার যদি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে পারে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা তৈরি করতে পারে, তবে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া সফল হতে পারে। অন্যথায়, দেশে আবারও অস্থিরতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বাংলাদেশ এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আশার আলো একদিকে জ্বলে উঠছে, অন্যদিকে রাজনৈতিক বিভাজন ও বহিরাগত প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ রয়ে গেছে। নতুন সরকার যদি সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে দেশ একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে এগোতে পারবে।
তবে, প্রশ্ন থেকেই যায়—“গণতন্ত্র কি সত্যিই ফিরে আসবে, নাকি আবারও পুরনো শাসনের ছায়ায় হারিয়ে যাবে দেশের স্বপ্ন?”