বিপ্লব শব্দটি যেমন আবেগে ভরপুর, তেমনি বাস্তবতায় কঠিন। এটি কখনো একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন, আবার কখনো এক দীর্ঘ বঞ্চনার প্রতিবাদ। বিপ্লবের সময় মানুষ একত্র হয়, একটি অভিন্ন লক্ষ্যে। কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম সত্য হলো—বিপ্লব সফল হতেই সেই একতা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। মতাদর্শ, নেতৃত্ব, কিংবা ক্ষমতার প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে পড়ে সেই বিপ্লব-সঙ্গীরাই। ফলে বিপ্লব-পরবর্তী সময় হয়ে ওঠে আরেক নতুন সংকটের নাম।
বিপ্লব-পরবর্তী বিভক্তির কারণ
বিপ্লব সাধারণত একটি নির্দিষ্ট দমনমূলক শাসনের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ। কিন্তু শাসনব্যবস্থা বিদায় নিলেই সামনে আসে নতুন প্রশ্ন—এখন রাষ্ট্র চালাবে কে? কেমন হবে শাসনব্যবস্থা? কে থাকবে নেতৃত্বে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ঘিরেই শুরু হয় বিভাজন। মূলত চারটি কারণে বিপ্লব-পরবর্তী বিভক্তি গভীর হয়ে থাকে:
1. ক্ষমতার লড়াই: একে অন্যকে ছাপিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
2. আদর্শগত পার্থক্য: সবাই বিপ্লব চেয়েছিল, কিন্তু সবাই একই আদর্শে বিশ্বাসী নয়।
3. দলীয় ও ব্যক্তিগত স্বার্থ: জাতীয় স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা বড় হয়ে দাঁড়ায়।
4. বিদেশি হস্তক্ষেপ: অনেকে আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের জন্য প্রতিযোগিতায় নামে।
ঐতিহাসিক উদাহরণ: যেভাবে ঐক্য ভাঙে
ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯):
‘স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব’-এর পতাকা নিয়ে ফরাসি জনগণ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু বিপ্লবের পর জ্যাকোবিন ও জিরন্ডিনদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। একপর্যায়ে রোবেসপিয়ারের নেতৃত্বে ‘ভয়ের শাসন’ কায়েম হয়—বিপ্লবীরাই বিপ্লবের শিকার হয়।
রুশ বিপ্লব (১৯১৭):
লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা জারতন্ত্রের পতন ঘটায়। কিন্তু বিপ্লবের পর মেনশেভিক, রাজতন্ত্রপন্থী ও নানা গোষ্ঠীর মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। পরে লেনিনের মৃত্যুর পর স্তালিন-ট্রটস্কির দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছে, যা একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে নিয়ে যায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট:
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি ঐতিহাসিক বিপ্লব। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আদর্শগত দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক নেতৃত্বে মতানৈক্য ও ক্ষমতার প্রতিযোগিতা জাতিকে বিভক্ত করে তোলে। সামরিক হস্তক্ষেপ ও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড আমাদের বিপ্লবের ঐক্যচেতনাকে আঘাত করে।
বিপ্লব-পরবর্তী বিভক্তির সমাধানে করণীয়
বিপ্লব-পরবর্তী বিভক্তি কোনো অনিবার্য পরিণতি নয়—সচেতন নেতৃত্ব, গঠনমূলক রাজনৈতিক পরিবেশ এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকলে এ বিভাজন এড়ানো সম্ভব। এজন্য নিচের কিছু করণীয় বাস্তবায়ন জরুরি:
1. অন্তর্দলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা:
রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোর ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে।
2. সংবিধান ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা:
একটি অংশগ্রহণমূলক সংবিধান এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ বিভক্তির পথ রোধ করতে পারে।
3. অন্তর্ভুক্তিমূলক নেতৃত্ব:
সকল গোষ্ঠী ও মতবাদকে সমান সুযোগ দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।
4. মতবিরোধকে সম্মান ও সংলাপের সংস্কৃতি:
ভিন্নমতকে দমন না করে তা শুনে সমাধানের পথ খুঁজে নিতে হবে।
5. জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ:
জনগণ যেন কেবল বিপ্লবের সময়ে নয়, বরং রাষ্ট্র পরিচালনায়ও অংশ নিতে পারে—তা নিশ্চিত করতে হবে।
6. বিদেশি হস্তক্ষেপ পরিহার:
নিজের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিলে বিপ্লবের আত্মা বাঁচে।
7. নেতৃত্বে আত্মসংযম ও পরিণত বোধ:
ব্যক্তি নয়, প্রতিষ্ঠান ও আদর্শকে এগিয়ে রাখা জরুরি। নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিরা এই চেতনা ধারণ না করলে বিভক্তি অনিবার্য।
সমাপ্তি
বিপ্লবের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হয় তার পরের অধ্যায়ে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—অনেক বিপ্লব সফল হলেও তার পরবর্তী বিভক্তি সেই সাফল্যকে ম্লান করে দেয়। সুতরাং বিপ্লব যেন শুধু ক্ষমতার হাতবদল না হয়ে ওঠে, বরং একটি টেকসই, ন্যায়ভিত্তিক ও সমন্বিত রাষ্ট্রব্যবস্থার সূচনা ঘটাক—এটাই হোক নেতৃত্ব ও জনগণের সম্মিলিত অঙ্গীকার।