যশোরের ঝিকরগাছার মঞ্জুয়ারা খাতুন ছোটবেলা ক’দিন স্কুলে গেলেও অক্ষরের সাথে পরিচিত হওয়ায় আগেই বন্ধ হয়েছিল আলো দেখার পথ। কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই মঞ্জুয়ারাকে বসতে হয় বিয়ের পিড়িতে। এরপর স্বামী-সংসার সামলানোর দিবানিশি অবৈতনিক কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পার করেছেন এক দশক। তবে এক দশক দুই দশক পরে হলেও অক্ষরকে রপ্ত করেছেন। শিখেছেন নাম লেখা। তবে তার এ নাম লেখা শেখার পেছনে যারা ভূমিকা রেখেছেন তারা হলেন তার সন্তানরা। মঞ্জুয়ারা খাতুন প্রতিকুলতাকে পায়ে মাড়িয়ে সন্তানদেরকে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন।
মঞ্জুয়ারা খাতুনের জন্ম ৬ জুলাই ১৯৭২ সালে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাউসা গ্রামে। পিতা জাহান আলী সরদার ও মাতা জবেদা খাতুনের ১২ সন্তানের মধ্যে সে ৫ম। আশি দশকের প্রথম দিকে মঞ্জুয়ারা খাতুনের বিয়ে হয় একই উপজেলার বল্লা গ্রামের সামছুর রহমানের সাথে। বিয়ের ৬-৭ বছরের মাথায় শ্বশুরালয়ে স্বামীর পৃথক সংসার হওয়ায় কারণে প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ে যান মঞ্জুয়ারা খাতুন। কিন্তু শত প্রতিকূলতা মঞ্জুয়ারার মনোবলকে দমাতে পারেনি। তার স্বপ্ন ছিল সন্তানদেরকে আলোর পথ দেখাবেন। সন্তানদেরকে মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তুলবেন। স্বপ্ন দেখতেন তার সন্তানেরা একদিন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে লেখাপড়া করবেন। সৃষ্টিকর্তা ঠিকই তার সেই ইচ্ছা পুরন করেছেন। মঞ্জুয়ারার দুই সন্তানই ‘প্রাশ্চের অক্সফোর্ড খ্যাত’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।
নিরক্ষর মঞ্জুয়ারার বড় ছেলে মো. আব্দুল কাদের ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে সমাজকল্যাণ বিভাগে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে এখন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। পুত্রবধূ আইরিন আখতার রাহা স্নাতকোত্তর। ছোট ছেলে মো. তুহিন কবীর ২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। বর্তমান তিনি বাংলাদেশ ক্রীড়াশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। পুত্রবধূ নাজমুন সুলতানা মুনমুন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
মঞ্জুয়ারার ছোট ছেলে তুহিন কবীরের দাবি, তাদের লেখাপড়ার পেছনে মায়ের অবদান সবচেয়ে বেশি। অনটনের সংসারে তিনি হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন করে ছেলেদের লেখাপড়ার খরচ যুগিয়েছেন। বিভিন্ন উৎসবে নিজে কখনো নতুন বস্ত্র পরেননি। কিন্তু ছেলেদেরকে অনটন বুঝতে দেননি।
তুহিন কবীর বলেন, মা সন্ধ্যা হলেই আলো জ্বালিয়ে আমাদের পাশে বসে থাকতেন। গভীর রাত পর্যন্ত আমাদেরকে পড়তে হতো। স্কুলে যাওয়া ও লেখাপড়ার বিষয় কখনো মায়ের ভূমিকা দেখে মনে হতো না তিনি নিরক্ষর। আমরা দুই ভাই পড়ার পাশাপাশি মাকে অক্ষর চিনিয়েছি। আমার মা এখন সাক্ষর করতে পারেন। তাই মনে করি আমরা বিশ্ববিদ্যালয় পড়েছি আর ‘আমার মা আমাদের শিক্ষক।’ মঞ্জুয়ারার স্বামী সামছুর রহমান মনে করেন, স্ত্রীর কারণে তার সন্তানরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে। অনটনের সংসারে ছেলেদের লেখাপড়ার খরচ অধিকাংশই স্ত্রী হাঁস-মুরগি পালনের মাধ্যমে জোগাড় করেছেন।
সামছুর রহমান বলেন, সংসারে যখন আমাদের আলাদা করে দিয়েছিল, তখন বাবা কোন সম্পত্তি দেয়নি। তাই দিনমজুর হিসেবে ক্ষেত-খামারে কাজ করেছি কিন্তু দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচ অধিকাংশই ওদের মা-ই জোগাড় করেছে। সন্তানদের মায়ের আগ্রহে আজ তারা লেখাপড়া শিখতে পেরেছে।
বল্লা (বিএনকে) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি মো.শফিউদ্দিন বলেন, নিরক্ষর মায়ের দুটি সন্তানই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করেছে যেটা সমাজে দৃষ্টান্ত। আমরা এই মা মঞ্জুয়ারা খাতুনকে স্যালুট জানাই।
মঞ্জুয়ারা খাতুন বলেন, স্কুল দূরে থাকায় আব্বা আমাকে স্কুলে যেতে দেয়নি। তাই আমি লেখাপড়া শিখতে পারেনি, সে জন্য আমার ইচ্ছা ছিল আমার সন্তানদের যেন আমি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারি।