বঙ্গোপসাগরে জলদস্যু দমনে র্যাবের ব্যাপক অভিযান; লুণ্ঠনকৃত বিপুল পরিমাণ মাছ ও জাল উদ্ধার এবং আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদসহ কুখ্যাত জলদস্যু সর্দার বাদশা ও তার পাঁচ সহযোগী গ্রেফতার
১। আপনারা জানেন, কক্সবাজারের জেলে সম্প্রদায়ের অসংখ্য লোক বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকার করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। ইঞ্জিনচালিত বোট ও ট্রলারে করে নদী ও সমুদ্র হতে ধৃত মৎস্য আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে চাহিদা পুরণ করে থাকে। এছাড়াও মৎস্য সম্পদ বিদেশে রপ্তানীর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক ভুমিকা পালন করে যাচ্ছে। কিন্তু জলদস্যুরা নদী ও সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের জাল, মাছ, নগদ টাকা-পয়সা ইত্যাদি লুট করার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠার ফলে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের জন্য রীতিমত আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সাথে জলদস্যুরা অনেক জেলেকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় ও ক্ষেত্রবিশেষ জেলেদের খুন পর্যন্ত করে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুদের দাপটে তটস্থ জেলেরা। র্যাবের একের পর এক অভিযানে টিকতে না পেরে এক পর্যায়ে সশস্ত্র জলদস্যুরা আত্মসমপর্ণ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু তাদের গডফাদাররা ধরা ছোয়ার বাইরে থেকে যায়। আত্মসমর্পণের পর সাগরে ডাকাতি কিছুদিন বন্ধ থাকলেও গডফাদাররা নতুন ডাকাত সদস্যদের নিয়ে পুনরায় জলদস্যু গ্রুপ তৈরী করে।
২। গত ২২/০১/২০২৪ ইং তারিখ কক্সবাজার জেলার মহেশখালী থানাধীন কুতুবজুম এলাকার বাসিন্দা পেশায় সমুদ্রে মৎস্য আহরণকারী জনৈক মোঃ বেলাল হোসেন র্যাব-১৫ এর সদর দপ্তরে এসে অভিযোগ করেন যে, গত ২১/০১/২০২৪ ইং তারিখ বিকেল অনুমান ১৬.৩০ ঘটিকায় একটি ইঞ্জিন চালিত ট্রলার যোগে অনুমান ১০/১২ জন অবৈধ অস্ত্রধারী ডাকাত বঙ্গোপসাগরে বাঁকখালী নদীর মোহনার অদূরে মৎস্য আহরণরত অবস্থায় তার মালিকানাধীন ইঞ্জিন চালিত মাছ ধরার ট্রলারে হামলা চালিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তার ট্রলারে থাকা আহরিত মাছ, মাছ ধরার জাল, বোটের ইঞ্জিনের মালামাল, তৈল ইত্যাদি লুট করে নিয়ে যায়। উক্ত অভিযোগের প্রেক্ষিতে লুণ্ঠনকৃত মালামাল উদ্ধার ও জলদস্যুদেরকে গ্রেফতার করার লক্ষ্যে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখার সার্বিক সহযোগিতায় র্যাব-১৫, কক্সবাজারের একটি চৌকস আভিযানিক দল গত ২৩/০১/২০২৪ ইং তারিখ সন্ধ্যা ১৮.০০ ঘটিকা হতে বঙ্গোপসাগরে ব্যাপক অভিযান শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় গত ২৫ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখ দিবাগত রাতে বঙ্গোপসাগরের বাঁকখালী নদীর মোহনায় একটি ইঞ্জিনচালিত ট্রলারকে আভিযানিক দলের সন্দেহ হলে র্যাবের আভিযানিক দল ট্রলারটির গতিরোধের চেষ্টা করে। এ সময় গ্রেফতারকৃত ডাকাতরা তাদের সঙ্গীয় পলাতক ডাকাতগণসহ র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে। র্যাবও পাল্টা গুলি করলে ০৫/০৬ জন জলদস্যু সমুদ্রে লাফ দিয়ে পালিয়ে যায়। তাৎক্ষনিক র্যাবের আভিযানিক দল ডাকাত/ জলদস্যুদের ট্রলারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ট্রলার থেকে জলদস্যুতার কাজে ব্যবহৃত অস্ত্র গোলাবারুদ ও ডাকাতি করা মাছ অন্যান্য মালামাল সহ ০৬ জন ডাকাতকে হাতেনাতে আটক করতে সক্ষম হয় এবং জলদস্যুদের হেফাজত হতে সর্বমোট ০৩টি দেশীয় তৈরী এলজি, ১৪টি কার্তুজ, ০৩টি ধারলো দা, ০২টি স্মার্ট ফোন এবং ০৮টি বাটন ফোন উদ্ধার করে।
৩। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায় যে, জলদস্যুদের গডফাদার পেকুয়ার রাজাখালীর নুরুল আবছার বদু, জালাল আহমদ এবং কুতুবদিয়ার ইসহাক প্রকাশ ইসহাক মেম্বার গত এক সপ্তাহ আগে নিজেদের ফিশিং ট্রলারে করে জলদস্যুদের সাগরে পাঠায়। গডফাদারদের নির্দেশনা অনুযায়ী আইনশৃংখলা রক্ষা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে নিজেদের ট্রলার নিয়ে রাজাখালীর কালু কোম্পানির বোট ডাকাতি করে মাঝিমাল্লাদের বেধড়ক পিটিয়ে অজ্ঞাত স্থানে নামিয়ে দিয়ে জলদস্যুরা কালু কোম্পানির বোট দিয়ে ডাকাতি শুরু করে যাতে গডফাদারদের চিহ্নিত করতে না পারে। পুরো এক সপ্তাহ তারা বঙ্গোপসাগরে ডাকাতি করে দাপিয়ে বেড়ায়। গডফাদারদের কাজ হলো অস্ত্র-গুলি এবং ট্রলারের যোগান দেয়া। বিভিন্ন ঘাটে ঘাটে সোর্সের মাধ্যমে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী সাগরে অভিযানে যাচ্ছে কিনা তা তদারকি করে জলদস্যুরা উপকূলে আসার সময় তা অবগত করা এবং বোট মালিক, মাছ ব্যবসায়ী হিসেবে ডাকাতির মাছ ও মালামাল বিক্রি করা। আর জলদস্যুরা সাগরে গিয়ে ডাকাতি করে মাছ এবং মালামাল বিক্রি করে যে টাকা পায় তার ৪০% গডফাদারদের, ২০% তেল খরচ এবং যারা সশস্ত্র ডাকাতি করেছে তারা ৪০%। এভাবেই ডাকাতির টাকা বন্টন হয় তাদের মাঝে। গ্রেফতারকৃত আল-আমিনের রেকর্ডপত্র যাচাই করে ০২টি এবং এরশাদের নামে ০১টি মামলার তথ্য পাওয়া যায়। উল্লেখ্য যে; পলাতক নুরুল আবছার বদু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের তালিকা ভুক্ত জলদস্যু। তার বিরুদ্ধে ডাকাতি সহ প্রায় ৩০টি মামলা রয়েছে। জালাল আহমদ এর বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা সহ প্রায় ১০টি মামলা রয়েছে এবং মোঃ ইসহাক প্রকাশ ইসহাক মেম্বারও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত জলদস্যু। তার বিরুদ্ধে ডাকাতি মামলা সহ প্রায় ১০টি মামলা রয়েছে।
৪। গ্রেফতারকৃত জলদস্যু দলের বিস্তারিত পরিচয়ঃ
১) মোঃ বাদশা (২৭), পিতা-মাহমুদ উল্লাহ, মাতা-রহিমা বেগম, সাং+ইউনিয়ন-লেমশিখালী, থানা-কুতুবদিয়া, জেলা-কক্সবাজার।
২) মোঃ আল-আমিন (২৫), পিতা-মোঃ আবু বক্কর, মাতা-মোছাঃ হাছনা বেগম, সাংনারিকলতলা (সেইলর কলোনী), ৩৯নং ওয়ার্ড, থানা-ইপিজেড, জেলা-চট্টগ্রাম।
৩) রায়হান উদ্দিন (২২), পিতা-মোঃ ইসমাইল, মাতা-মোতাহেরা বেগম, সাং-জুলেখাবিবির পাড়া, ৪নং ওয়ার্ড, দক্ষিণ ধুরুং ইউনিয়ন, থানা-কুতুবদিয়া, জেলা-কক্সবাজার।
৪) এরশাদুল ইসলাম (২০), পিতা-মৃত কবির আহমদ, মাতা-রহিমা বেগম, সাং-পেচারপাড়া, ২নং দক্ষিণ ধুরুং ইউনিয়ন, থানা-কুতুবদিয়া, জেলা-কক্সবাজার।
৫) মোঃ মারুফুল ইসলাম (২২), পিতা-রহিম উল্লাহ, মাতা-খাদিজা বেগম, সাং-মুসালিয় শিকদার পাড়া, লেমশিখালী ইউনিয়ন, থানা-কুতুবদিয়া, জেলা-কক্সবাজার।
৬) মোঃ রাফি (১৯), পিতা-মোঃ ইউনুছ, মাতা-নুরুন্নাহার, সাং-সাহারুম শিকদার পাড়া, দক্ষিণ ধুরুং ইউনিয়ন, থানা-কুতুবদিয়া, জেলা-কক্সবাজার।
৫। গ্রেফতারকৃত মোঃ বাদশা একজন কুখ্যাত জলদস্যু সর্দার। কক্সবাজার অঞ্চলে মাছ ধরার সঙ্গে যুক্ত জেলে সম্প্রদায় ও অন্যান্যদের নিকট আতংকের অপর নাম বাদশা ডাকাত। জলদস্যু দলকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, বাদশা ডাকাতের নেতৃত্বে আটককৃত জলদস্যু ডাকাত দলটি দীর্ঘদিন যাবত জলদস্যুতাসহ নানাবিধ অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত রয়েছে। তারা সুযোগ বুঝে নদী ও সাগরে মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত জেলেদের অস্ত্র-শস্ত্রের ভীতি প্রদর্শনসহ ট্রলার ও নৌকায় ডাকাতি করে থাকে। উল্লেখ্য, গ্রেফতারকৃত ডাকাত দলটিতেও বরাবরের মতে প্রধান ভূমিকায় ছিল এই বাদশা ডাকাত।
৬। গ্রেফতারকৃত এবং পলাতক জলদস্যুদের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন।