দখল-দূষণের কবলে পড়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে লক্ষ্মীপুরের ঐতিহ্যবাহী রহমতখালী খাল। প্রভাবশালীরা অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করে দখল করে নিয়েছে খালটির দুপাশ। এতে বন্ধ হয়ে পড়েছে খালের পানির প্রবাহ।
বাজার এলাকাসহ জেলা শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে ময়লা-আবর্জনা ফেলানোয় এখন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে খালের পানি। ফলে হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য, বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, খালটি সংস্কারের জন্য প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। আর জেলা প্রশাসন বলছে, শিগগিরই দখলদারদের তালিকা করে চালানো হবে উচ্ছেদ অভিযান।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ, মান্দারি, জকসিন ও পৌর শহরের বাজার এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে রহমতখালী খাল। যার দৈর্ঘ্য ৪০ কিলোমিটার। এক সময় এ রহমতখালী খাল ছিল খরস্রোতা। এ খাল দিয়ে ভোলা-বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লক্ষ্মীপুরে পণ্য সামগ্রী নিয়ে বড় বড় নৌকায় আসা-যাওয়া করতেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু দখল এবং দূষণের কবলে পড়ে খালটি এখন প্রায় মৃত।জেলা শহর এবং শহরের বাইরের বাজারগুলো থেকে এ খালে ফেলা হচ্ছে বাজারের উচ্ছিষ্ট ও প্লাস্টিক বর্জ্য। বাসাবাড়ির মানববর্জ্যও পড়ছে এ খালে। এতে খালের পানি পচে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য। খালটি দখল ও দূষণমুক্ত রাখতে এ ধরে নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ। স্থানীয়দের অভিযোগ, পৌর কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় খালের দূষণ দিন দিন মারাত্মক আকার ধারণ করছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রহমতখালী খালের প্রায় ৫ কিলোমিটার অংশ পড়েছে পৌর এলাকায়। এর মধ্যে প্রায় দুই কিলোমিটার অংশ পৌর বাজার এলাকা দিয়ে বহমান। বাজারের অংশে খালে এখন আর্বজনায় ভরপুর। সেগুলো পচে পোকামাকড় কিলবিল করছে। আর পানির রং ধারণ করেছে কালো রঙে। বিশেষ করে বাজারে গোশত হাটের পাশ দিয়ে থাকা খালের এ অংশটির কারণে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে ভয়ানকভাবে। ওই অংশে গরু-ছাগল এবং হাঁস-মুরগির জবাইয়ের উচ্ছিষ্ট খালে ফেলা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।বাজারের সব ধরনের আর্বজনা ও প্লাস্টিক বর্জও পড়েছে খালটিতে। খালের সবস্থানে আর্বজনা না ফেললেও বাজার অংশের কারণে পুরো খালের পানি এখন দূষিত হয়ে আছে।
বাজারের গোশত হাটের কয়েকটি মুরগি দোকানের পেছনের অংশ রয়েছে খালের ওপর। খোদ পৌর কর্তৃপক্ষ ওই দোকানগুলো নির্মাণ করেছেন। বাজার ব্রিজ অংশের পূর্ব এবং পশ্চিম পাশের ভবনগুলোর একাংশ খালের ওপর। এতে ওইস্থান দিয়ে খালটি পুরো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। অথচ এক সময়ের খরস্রোতা এই রহমতখালী খালের প্রস্থ ১৭ মিটার। বর্তমানে অবৈধ দখল ও দূষণের কবলে পড়ে পৌর শহর অংশে এখন খালটির প্রস্থ দাঁড়িয়েছে ৮ থেকে ১০ মিটারে।
এদিকে খালটির পৌর অংশে দূষণমুক্ত রাখার কাজটি দেখভালের দায়িত্ব পৌর কর্তৃপক্ষের। এজন্য প্রতি বছর এডিপি থেকে বরাদ্দও আসে। কিন্তু খালটি পরিষ্কার হয়নি। খাল পাড়ের বাসিন্দারা খাল দূষণের জন্য দুষছেন পৌর কর্তৃপক্ষ ও বাজারের ব্যবসায়ীদের। আবার পৌর মেয়র দুষছেন পৌরবাসীর অসচেতনতাকে। খাল পাড়ের বাসিন্দা বাদশা হোসেন বলেন, ‘দূষণের ফলে খালের পানি দুর্গন্ধের কারণে আমাদের বসবাস করা কষ্ট হয়। শিশুরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বাজারের এ অংশটি অন্তত পরিষ্কার রাখার জন্য আমরা বার বার পৌর মেয়রকে বিষয়টি জানিয়েছি। কিন্তু কখনো পরিষ্কার রাখা হয়নি। পৌর কর্তৃপক্ষ পারে বাজারের ব্যবসায়ীদের ময়লা আর্বজনা খালে না ফেলে অন্যত্র ফেলার ব্যবস্থা করতে। কিন্তু কখনো কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি লক্ষ্মীপুর পৌরসভা।
পৌর শহরের বাসিন্দারা জানান, বাজারের কয়েকটি স্থানে খাল দখল হয়ে আছে। বিভিন্ন ভবনের পেছনের অংশ খালের মধ্যে। এতে খাল সংকুচিত হয়ে গেছে। বাসাবাড়ি ও বাজারে ময়লা আর্বজনাতে খাল ভরাট হয়ে আছে। খালের পানি প্রবাহ বন্ধ থাকায় পানি দূষিত হয়ে পড়েছে। খালপাড় সংলগ্ন উত্তর মজুপুর এলাকার বাসিন্দা মো. রুবেল হোসেন বলেন, কয়েক বছর আগেও আমরা খালের পানিতে গোসল করতাম। রান্না-বান্নার কাজে পানি ব্যবহার করা হতো। পানি একেবারে স্বচ্ছ ছিল। কিন্তু এখন পানি থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। বাজার কেন্দ্রীক খাল বেশি দূষণের কারণে ওই দূষিত পানি পুরো খালে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন জোয়ারের পানিও ঢুকতে পারছে না।
৬৫ বছর বয়সী সফিক উল্যা বলেন, এ খাল দিয়ে মালবাহী নৌকা চলতো। আমরা নিজেরাও খাল দিয়ে চলাচল করেছি। কিন্তু এখন খালের যে অবস্থা, এখনকার মানুষ সেগুলো বিশ্বাস করবে না। ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবদুর রশিদ বলেন, এ খাল থেকে মাছ শিকার করে বিক্রি করতাম। এক সময় প্রচুর মাছ ছিল। এখন মাছের পরিবর্তে ময়লা-আর্বজনার পোকা-মাড়ক কিলবিল করছে।
খাল দূষণের কথা স্বীকার করে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার মেয়র মোজাম্মেল হায়দার মাসুম ভূঁইয়া বলেন, দখল এবং দূষণের কারণে খালের অবস্থা একেবারে বেহাল। বাজারে ময়লা আর্বজনা এবং বাসাবাড়ির ময়লার পাইপ লাইন খালে দেওয়া হয়েছে। মানুষ সচেতন না। এ কারণে তারা খালটি দূষণ করছে। আমরা মাঝেমধ্যে খাল পরিষ্কার করি। কিন্তু অসচেতন মানুষরা আবার খাল দূষণ করে ফেলে। লোকজনকে সচেতন করা গেলে এবং খালকে বেদখল করা গেলে অস্তিত্ব টিকানো যাবে।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী গোকুল চন্দ্র পাল বলেন, রতমতখালী খালের ১৮ কিলোমিটার খনন করার জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। খালটি সংস্কার করা গেলে দূষণ রোধ হবে।
লক্ষ্মীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব, উন্নয়ন ও মানব সম্পদ) পদ্মাসন সিংহ বলেন, রহমতখালী খালটিকে বাঁচাতে দখলদারদের তালিকা করে শিগগিরিই চালানো হবে উচ্ছেদ অভিযান।লক্ষ্মীপুরের জেলা শহরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া রহমতখালী খালটি দৈর্ঘ্য ৪০ কিলোমিটার। এরমধ্যে সদর উপজেলার অংশে পড়েছে ১৮ কিলোমিটার।