চীন থেকে আমদানী করা সিলেটের রসুন বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন অবৈধভাবে ভারতে যাচ্ছে। সিলেট নগরী এবং বিভিন্ন সীমান্ত এলাকার একটি সিন্ডিকেট এই রসুন পাচারের সাথে যুক্ত রয়েছে। এই রসুনের বিনিময়ে ভারত থেকে আসছে এলসি পেঁয়াজ এবং চিনি। ব্যবসায়ী সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে প্রতিদিন সিলেট থেকে দুই থেকে আড়াই হাজার বস্তা রসুন ভারতে যাচ্ছে। তবে, এই হিসেবের চেয়ে আরো কয়েকগুণ বেশী রসুন ভারতে যাচ্ছে বলে অভিমত একাধিক ব্যবসায়ীর। এতে আমদানীর উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার পাশাপাশি রপ্তানী আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য চীনের দিকে চলে যাবে বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চাহিদা থাকলেও ভারতে চীনের রসুন প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অন্যদিকে চীনের রসুনের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে সারা দেশের মতো সিলেটেও। চাহিদা থাকায় সিলেটে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে রসুন আসছে। এতো রসুন আসার পরও রসুনের চাহিদা শেষ হচ্ছে না। রসুন আসার পর পাইকারীবাজার থেকে রাতারাতি সেগুলো উধাও হয়ে যাচ্ছে। লাভ হলেও হঠাৎ করে রসুনের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবসায়ীরাও অবাক। কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, সিলেটের বৃহৎ পাইকারী বাজার কালিঘাটের এই রসুনগুলো ভারতের বিভিন্ন বাজারে প্রবেশ করছে।
কালিঘাট ব্যবসায়ীদের একটি সূত্র জানায়, কালিঘাটে অন্তত শতাধিক পাইকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় প্রতিদিন কালিঘাটে রসুন ভর্তি ট্রাক দিনে-রাতে লোড হচ্ছে। লোড শেষে বিভিন্ন সীমান্ত এলাকার উদ্দেশে কালিঘাট ছেড়ে যাচ্ছে ট্রাকগুলো। এই অবৈধ কারবারের সাথে জড়িত রয়েছে একটি সিন্ডিকেট। সেই সিন্ডিকেটে রয়েছে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল নামধারী একদল তরুণও। যারা হঠাৎ করে রসুন ব্যবসায়ী বনে গেছেন এবং রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠছেন। সিলেট থেকে সীমান্ত এলাকায় নেয়ার পর সেগুলো হাতবদল হয়। সীমান্ত এলাকার কতিপয় ব্যবসায়ী সেগুলো ভারতে পৌঁছানোর কাজে দায়িত্ব পালন করেন।
কালিঘাটের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ভারতে রসুন পাচারের বিষয়টি দীর্ঘদিনের। তবে, সাম্প্রতিককালে এ প্রবণতা বেড়ে গেছে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বর্তমানে এলসির পেঁয়াজ সিলেটে আমদানী বন্ধ রয়েছে। কিন্তু আমদানী বন্ধ থাকার পরও বাজারে পাওয়া যাচ্ছে সেই পেঁয়াজ। সেগুলো আসছে ভারত থেকে। তারা বলছেন, আমাদের কাছ থেকে চীনা রসুন যেভাবে যাচ্ছে, একইভাবে বিনিময়ে আসছে এই পেঁয়াজ। পেঁয়াজের সাথে অবাধে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে চিনি। শুধু রাতে নয়, দিন দুপুরেও সেগুলো দেদারছে আসা-যাওয়া করছে। কানাইঘাটের একেবারে সীমান্ত ঘেঁষা সুরিঘাট বাজারে একজন ব্যবসায়ী বলেন, পঞ্চাশ কেজি ওজনের ভারতীয় চিনির বস্তা দিনদুপুরে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। স্থানীয় একটি চক্র এই কাজের সাথে জড়িত রয়েছে। সেই চিনি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে চলে যাচ্ছে সিলেটের বিভিন্ন বাজারে।
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার বিছনাকান্দি, সুনারহাট, পান্তুমাই (পাদুয়া), সংগ্রাম, তামাবিল, জৈন্তাপুর উপজেলার লালাখাল, জৈন্তাপুর রাজবাড়ী, লালাখাল, ডিবির হাওর, মিনাটিলা, শ্রীপুর, কানাইঘাট উপজেলার লোভাছড়া-নুনছড়া, সুরিঘাট (বাদশাবাজার এলাকা) সহ জকিগঞ্জ ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার অন্তত অর্ধশতাধিক স্পট দিয়ে এই পণ্যসামগ্রী আদান-প্রদান হচ্ছে।
সিলেটের সীমান্ত এলাকার একাধিক ব্যক্তি জানান, ভারতের মেঘালয়, আসামসহ আশপাশের এলাকায় রসুনের দাম তুলনামূলক বেশি। তাই, চীন থেকে বাংলাদেশে আনা রসুন চোরাইপথে পাচার হচ্ছে অধিক মুনাফার লোভে। সিলেটের সবগুলো সীমান্ত দিয়ে দিন-কিংবা রাতে সমান তালে এসব পণ্য সামগ্রী আদান-প্রদান হচ্ছে।নাম প্রকাশ না করা শর্তে বিজিবি’র একটি সূত্র জানায়, সিলেটের সবগুলো সীমান্তে তাদের কড়া নজরদারি রয়েছে। এরপরও তাদের গতিবিধিনজরদারিতে রাখে চোরাকারবারিরা। তাদের স্থান পরিবর্তনের সুযোগ চোরাকারবারিরা কাজে লাগাচ্ছে বলে তার মন্তব্য।
একইভাবে ভারতীয় চিনি জব্দের বিষয়টি স্বীকার করে কানাইঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহাঙ্গীর হোসেন সর্দার বলেন, চোরাকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সিলেটের বিশিষ্ট আইনজীবী ইইউ শহীদুল ইসলাম শাহীন বলেন, ভারতে রসুন যত যাবে, আমদানী তত বাড়বে। এতে ভারসাম্য বাংলাদেশে নয়, চীনের দিকে চলে যাবে। তিনি বলেন, আমাদের দেশীয় পেঁয়াজ উৎপাদনের এখন ভরা মৌসুম। এই সময় যদি ভারত থেকে রসুনের বদলে অবাধে পেঁয়াজ প্রবেশ করে; তাহলে দেশীয় উৎপাদনকারীরা মার খাবে। সেই উৎপাদনকারীরা যদি একবার মুখ ফিরিয়ে নেয় , তাহলে আমাদের বিরাট ক্ষতি হবে।
সিলেট চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি তাহমিন আহমেদ জানান, রসুন যাওয়া কিংবা পেঁয়াজ আসা, এর পেছনে লাভবান হচ্ছে ব্যবয়ীদের চেয়ে অব্যবসায়ীরা। এটি নিয়ন্ত্রণ করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব আইন শৃংখলা বাহিনীর।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, পাচারকারীরা চীন থেকে আমদানি করা রসুন কালিঘাট থেকে কিনে থাকে ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকা কেজি হিসেবে। আর ভারতের চোরাকারবারীদের কাছে তা বিক্রি করা হয় ১৮০ টাকা কেজি দরে। চোরাকারবারীদের হাত থেকে বাজারে যাওয়ার পর সেটি ভারতের স্থানীয় বাজারে ২৫০ থেকে ২৭০ টাকা পর্যন্ত কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।