সরেজমিনে শনিবার (১০ ফেব্রুয়ারি) সকালে ঢাকা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনের পূর্ব পাশের প্লাটফর্মে দেখা যায়, ডিউটিতে থাকা রেলওয়ে পুলিশের সদস্যরা ভাগে ভাগে কোথাও একত্রে দু’জন, কোথাও তিনজন আবার কোথাও একাকী বসে মোবাইল টিপায় গভীর মনোযোগ। স্টেশনের কোথায় কি হচ্ছে সেদিকে তাদের দৃষ্টি নেই। হটাৎ স্টেশনে ঢাকাগামী একটি ট্রেন থামলে দেখা যায় তারা মোবাইল পকেটে রেখে ট্রেন থেকে নামা যাত্রীদের টিকেট চেকিং করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। টিকেট বিহীন যাত্রী পেলেই টাকা দাবি করছেন। টাকা পেলে ছেড়ে দিচ্ছেন, টাকা না পেলে আটকিয়ে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। এভাবে যার কাছ থেকে যা আদায় করতে পারছেন নিয়ে পকেটে পুরছেন। কিছুক্ষণ এভাবে চলে। স্টেশনের সিসি ক্যামেরায় এসব ঘটনা দৃশ্যমান।
দেখা যায়, সেই ট্রেন স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার পর পুলিশ সদস্যরা একে অপরের সাথে আলাপচারিতা শুরু করেন। তাদের হাস্যরস দেখে মনে হয়েছে- কে বেশি, কে কম টাকা যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করেছেন সে হিসেব নিয়েই আলোচনা হচ্ছে। একটুপরেই আবার তারা মোবাইল নিয়ে মনোযোগী হয়ে পড়েন।
বিমানবন্দর স্টেশন থেকে কমলাপুর ট্রেনে যাতায়াতকারী একজন নিয়মিত যাত্রী আবুল হোসেন অভিযোগ করেন, ‘স্টেশনে বসে বসে মোবাইল টিপা আর টিকেট চেকের নামে হয়রানি করা ছাড়া যাত্রী সেবায় রেলওয়ে পুলিশের কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে। যাত্রীদের বসার জায়গা তারা দখল করে রাখে। কখনো কখনো যাত্রীদের উঠিয়ে দিয়ে সেই যায়গায় তারা বসে।’
কয়েকজন যাত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘তারা যদি এভাবে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তাহলে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও নাশকতাকারীদের চিহ্নিত করবে কে? এছাড়া টিকেট কালোবাজারীদের ধরতেও তারা ব্যর্থ। ধরবে কি! তারাই তো টিকেট কালোবাজারীদের সাথে জড়িত। আসলে জবাবদিহিতা নেই বলেই তারা এমন করতে পারছে।’
বিমানবন্দর স্টেশনের পশ্চিম পাশের প্লাটফর্মের শেষের দিকে একদল মাদকাসক্ত কিশোর-যুবককে আড্ডা দিতে দেখা যায়। তারা প্লাটফর্মে বসে প্রকাশ্যে মাদক সেবন করে। এছাড়া তারা উৎ পেতে থাকে। স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়ার সময় ট্রেনের জানালা দিয়ে যাত্রীদের মোবাইল থাবা দিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। সেদিকে পুলিশের নজর নেই। পুলিশকে অভিযোগ করলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়না বলে জানান ভুক্তভোগীরা।
স্টেশনের এক দোকানদার জানান, ‘কয়েকদিন আগে সকালে চট্টগ্রামগামী বিরতিহীন সোনার বাংলা এক্সপ্রেস স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়ার সময় এসব ড্যান্ডিখোর ছেলেদের একজন জানালা দিয়ে এক যাত্রীর মোবাইল থাবা দিয়ে নিয়ে যায়। লোকজন ধরার চেষ্টা করলে সে লোহার গ্রিল টপকে পালিয়ে যায়। এমন ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে আমাদের সামনে। আমরা এদের কিছু বলতে পারিনা। কিছু বলার দায়িত্ব তো প্রশাসনের।’
পুলিশ, আনসাররা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় কিনা এ বিষয়ে কি জানেন? প্রশ্ন করা হলে ওই দোকানি বলেন, ‘পুলিশ, আনসাররা তাদের কাছ থেকে ভাগ পান। তাই ব্যবস্থা নেন না।’
নাজমুল হোসেন নামক কলেজ পড়ুয়া এক ছাত্র জয়দেবপুর থেকে ঢাকাগামী টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনে উঠেন, তাড়াহুড়ো করে কাউন্টার থেকে টিকিট কাটতে পারেননি। ট্রেনের ভেতরে একজনকে ভাড়া বাবদ পঁয়তাল্লিশ টাকা দেন। টাকা নেওয়ার পরে ওই চেকার কোনো টিকেট বা রিসিট দেননি। বলেছেন, স্টেশনে নামলে কোনো সমস্যা হবে না, তিনি দেখবেন।
নাজমুল বিমানবন্দর স্টেশন নামার পরেই দু’জন রেলওয়ে পুলিশ আটকিয়ে তার টিকেট দেখতে চায়। কিন্তু তিনি টিকেট দেখাতে ব্যর্থ হোন। চেকারকে ভাড়া দিয়েছেন এবং জয়দেবপুর থেকে উঠেছেন বললে পুলিশ তা মানতে নারাজ। তাদেরকেও টাকা দিতে হবে দাবি করেন। ততক্ষণে ট্রেন কমলাপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেছে। ওই চেকারকে ডাকার সুযোগ নেই। পুলিশ দাবি করেন ট্রেন যেখান থেকে এসেছে সেখানের পুরো ভাড়া ও জরিমানা সহ ডবল ভাড়া দিতে হবে। এতো টাকা তার কাছে নেই বললে একজন পুলিশ নাজমুলের কলার চেপে ধরে টেনে নিয়ে যেতে চায়। এসময় আরেকজন পুলিশ নাজমুলের কানে কানে বলেন, যা আছে দিয়ে চলে যাও। পরে ১০০ টাকা দিয়ে তাদের ম্যানেজ করেন নাজমুল। স্টেশনে নাজমুলের সাথে প্রতিবেদকের কথা হলে এসব তথ্য দেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্টেশনের বাইরে সবসময় সিএনজি, অটোরিকশা ও হকারদের বিশৃঙ্খলা লেগেই থাকে। তা নিয়ন্ত্রণ করা রেলওয়ে পুলিশের দায়িত্ব হলেও উল্টো তারা সিএনজি, অটোরিকশা চালক ও হকারদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বসতে দেয়। সে কারণে স্টেশনে প্রবেশ ও বাহির হওয়ার সময় যাত্রীদের ভোগান্তির শেষ নেই। পুলিশদের টাকা দিতে হয় বলে সিএনজি, অটোরিকশা চালকরা ভাড়াও বেশি দাবি করে। এছাড়া পুলিশদের চাঁদা দেওয়ায় অযুহাতে স্টেশন এলাকায় খাবারের দামও বেশি রাখে। বর্তমানে রেল যাত্রীদের হিজড়াদের চাঁদাবাজি নিয়ে বিস্তর অভিযোগ। কিন্তু রেলওয়ে পুলিশ এ ব্যাপারে কোন ধরনের ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। ট্রেনের ছাদে ও ইঞ্জিনে যাত্রী নেওয়ায় হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এই আদেশ বাস্তবায়নেও রেলওয়ে পুলিশ পুরোপুরি ব্যর্থ।